পুরুষ কি কেবল সংসারের ঘানি টানার যন্ত্র? নাকি তারা-ই পরিবারের অব্যক্ত নীরব নায়ক?
পুরুষরা আসলে কি ? সংসারের ঘানি টানা তাদের নিয়তি ?
জহুরুল ইসলাম ,প্রধান সম্পাদক || বিএমএফ টেলিভিশন
সমাজে পুরুষদের ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা আলোচনা চলছে। সাধারণ ধারণা হলো—পুরুষরা সংসারের ঘানি টানার জন্য জন্ম নেয়, পরিবার চালানোর দায়িত্ব যেন একমাত্র তাদের কাঁধেই। অথচ এ বাস্তবতায় পুরুষরা প্রতিনিয়ত মানসিক ও শারীরিক চাপে ভুগছেন। স্ত্রীর প্রতি আবেগ, দায়িত্ব ও ভালোবাসা থাকলেও “সেকেন্ডে সেকেন্ড” বউদের মনের পরিবর্তন একজন স্বামীর জন্য ভীষণ কষ্টকর হয়ে ওঠে। পরিবারের সুখ-শান্তির পেছনে পুরুষের যে আত্মত্যাগ ও অবদান রয়েছে, তা প্রায়শই অবমূল্যায়িত হয়। এই প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে—পুরুষ আসলে কী, তাদের দায়িত্ব ও ত্যাগের গভীরতা, পারিবারিক সম্পর্কে মানসিক চাপের প্রভাব, এবং সমাজে পুরুষকে নতুনভাবে দেখার প্রয়োজনীয়তা।
মানুষ সভ্যতার শুরু থেকেই পরিবার গড়ে তুলেছে। আর পরিবারের ভিত গড়ে ওঠে নারী-পুরুষের সম্মিলিত অবদানের ওপর। তবে সমাজ কাঠামো এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে পুরুষকে সবসময় বলা হয়েছে— “তুমি সংসারের ঘানি টানবে, দুঃখ কষ্ট সইবে, পরিবারের বোঝা কাঁধে নেবে।”
পুরুষের চোখের পানি দেখলে মানুষ বলে— “এত আবেগী হলে চলবে কীভাবে?” আবার সংসারের দায়িত্বে একটু পিছিয়ে পড়লেই বলা হয়— “পুরুষ হয়েও সংসার সামলাতে পারছ না?” এই দ্বৈত মানদণ্ডের শিকার হয় প্রায় প্রতিটি পুরুষই।
বিয়ের পর স্বামী হয়ে ওঠে স্ত্রীর, সন্তানের, এমনকি অনেক সময় পুরো পরিবারের মূল ভরসা। কিন্তু এই ভরসার পেছনে লুকিয়ে থাকে অসংখ্য অদৃশ্য ত্যাগ, মানসিক চাপ, আর সহ্যশক্তির পরীক্ষা। স্ত্রীদের আবেগময় মানসিক পরিবর্তন, যা অনেক সময় ক্ষণিকের রাগ বা অভিমান থেকে আসে, সেটাও স্বামীর জন্য গভীর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তাহলে প্রশ্ন জাগে—
পুরুষরা কি আসলেই শুধু সংসারের বোঝা টানার জন্য জন্মায়?
তাদের কষ্ট, আবেগ, ক্লান্তি—এসবের কি কোনো জায়গা নেই?
ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট
১. প্রাচীন সমাজে পুরুষের ভূমিকা
মানব সমাজের শুরুতে পুরুষের প্রধান দায়িত্ব ছিল শিকার, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং খাদ্য জোগাড় করা। নারী ছিল গৃহকেন্দ্রিক, সন্তান প্রতিপালন আর পরিবার দেখাশোনার দায়িত্বে। এই বিভাজনটা স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিল, কারণ শারীরিক শক্তিতে পুরুষ এগিয়ে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে এই দায়িত্বকে সমাজ একটা স্থায়ী নিয়ম বানিয়ে ফেলে।
২. মধ্যযুগীয় পরিবার কাঠামো
মধ্যযুগে এসে পুরুষকে বলা হলো—
“তুমি উপার্জন করবে, ঘর সামলাবে, সন্তানকে মানুষ করবে। তোমার কষ্টের জায়গা সমাজ বুঝবে না, কারণ পুরুষ কাঁদে না।”
এই চিন্তাধারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুরুষকে এক ধরনের অদৃশ্য শৃঙ্খলে বেঁধে রেখেছে।
৩. আধুনিক সমাজে চাপ
আজকের আধুনিক সমাজেও সেই চাপ কমেনি। বরং বেড়েছে। এখন পুরুষদের থেকে প্রত্যাশা করা হয়—
- ভালো উপার্জন করতে হবে
- সংসারে অভাব রাখতে হবে না
- স্ত্রীর চাহিদা পূরণ করতে হবে
- সন্তানকে সেরা স্কুল-কলেজে পড়াতে হবে
- বাবা-মায়ের দায়িত্বও নিতে হবে
অন্যদিকে, যদি কোনো কারণে পুরুষ সামান্য পিছিয়ে পড়ে, তখনই সে হয়ে যায় “অযোগ্য স্বামী”, “অযোগ্য বাবা” বা “ব্যর্থ মানুষ”।
এতক্ষণে আমরা দেখলাম— ইতিহাস থেকে আধুনিকতা পর্যন্ত, পুরুষ সবসময় সংসারের ভার নিজের কাঁধে বহন করে এসেছে। কিন্তু এই চাপের ভেতরে তাদের মনের দুঃখ, আবেগ আর কষ্টকে প্রায় কেউ গুরুত্ব দেয়নি।
পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক চাপ ও আবেগ লুকানোর সংস্কৃতি
পুরুষের মানসিক জগত: অদৃশ্য বোঝা
পুরুষ মানেই শক্ত, সহ্যশক্তি সম্পন্ন, আবেগহীন— এই ধারণা আমাদের সমাজে গভীরভাবে গেঁথে আছে। ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের শেখানো হয়—
- “কাঁদবি না, ছেলে মানুষ কাঁদে না।”
- “মেয়েদের মতো আবেগী হবি না।”
- “কষ্ট হলেও সহ্য কর, পুরুষ মানুষ কষ্ট লুকায়।”
এই শিক্ষার ফলেই পুরুষরা ধীরে ধীরে নিজেদের ভেতরের আবেগ গোপন করতে শেখে। তারা চাইলেও কাঁদতে পারে না, কষ্ট প্রকাশ করতে পারে না। আর এভাবেই তৈরি হয় এক বিশাল মনস্তাত্ত্বিক চাপের পাহাড়।
সংসার চালানোর অদৃশ্য চাপ
একজন স্বামীকে প্রতিদিন ভাবতে হয়—
- বাজার খরচ মেটানো যাবে তো?
- স্ত্রীর ইচ্ছা পূরণ করতে পারব তো?
- সন্তানের স্কুল ফি দেব কীভাবে?
- বাবা-মায়ের ওষুধের খরচ কভার হবে তো?
এসব চিন্তা মাথার ভেতর চলতে থাকে সারাক্ষণ। বাইরে থেকে সে হয়তো হাসিখুশি থাকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে টেনশনের দমচাপা আগুন জ্বলতে থাকে।
স্ত্রীর আবেগী মাইন্ডচেঞ্জ: পুরুষের দ্বিধা
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো আবেগ ও বোঝাপড়া। কিন্তু স্ত্রীদের ক্ষণিকের রাগ, অভিমান, মান-অভিমান— অনেক সময় স্বামীদের জন্য হয়ে দাঁড়ায় গভীর মানসিক চাপ।
এক সেকেন্ডে স্ত্রী খুশি, পরের সেকেন্ডে রাগান্বিত— স্বামীর পক্ষে এই হঠাৎ পরিবর্তন মানিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে যায়। সে চায়— সংসারটা শান্তিতে চলুক। কিন্তু প্রতিবার মানসিক ওঠানামা সামলাতে গিয়ে সে ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
একজন পুরুষ তখন ভাবে—
“আমি কি শুধু উপার্জনের মেশিন? আমার কষ্ট কেউ দেখে না?”
আমার আবেগের দাম নেই কেন? আমি মানুষ না?”
আবেগ দমন: নীরব কষ্ট
অনেক পুরুষ নিজের কষ্ট প্রকাশ না করে ভেতরে ভেতরে গুমরে মরে। কারণ—
- সমাজ তাকে দুর্বল ভাববে
- স্ত্রী বলবে— “এত ছোটখাটো ব্যাপারে তুমি কষ্ট পাও?”
- বন্ধুরা মজা করবে— “তুই তো বউয়ের ভয়ে আছিস।”
ফলে পুরুষরা নিজেদের একাকিত্বে ডুবে যায়। বাইরে থেকে তারা হাসিখুশি থাকে, কিন্তু ভেতরে তারা ভাঙতে থাকে।
এর ফলাফল কী?
১. ডিপ্রেশন: প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেক পুরুষ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
২. রাগী হয়ে ওঠা: আবেগ প্রকাশ করতে না পারায় তারা হঠাৎ রেগে যায়।
৩. সম্পর্কে দূরত্ব: স্ত্রীর সাথে খোলামেলা কথা না বলে চুপচাপ হয়ে যায়, ফলে দাম্পত্য সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়।
৪. স্বাস্থ্য সমস্যা: চাপের কারণে হাই ব্লাড প্রেসার, হার্টের অসুখ, ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়।
এখানে আমরা দেখলাম, পুরুষের আবেগ লুকানো আসলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায়।
পুরুষের ভূমিকা বনাম নারীর প্রত্যাশা: সংঘাত ও সমাধান
পুরুষের ভূমিকা: দায়িত্বের সাগর
একজন পুরুষ যখন সংসার শুরু করে, তখন তার জীবনে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় পরিবার।
- স্ত্রীকে সুখী রাখা
- সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা
- বাবা-মায়ের দায়িত্ব নেওয়া
- সমাজ ও আত্মীয়দের কাছে সম্মান বজায় রাখা
এ যেনো প্রতিদিনের যুদ্ধ। পুরুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই এই দায়িত্বের হিসাব-নিকাশে কাটে।
নারীর প্রত্যাশা: ভালোবাসা, মনোযোগ ও নিরাপত্তা
একজন স্ত্রী তার স্বামীর কাছে চায়
- ভালোবাসা
- মনোযোগ
- নিরাপত্তা
- সম্মান
- আবেগের বোঝাপড়া
কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন পুরুষ তার দায়িত্ব পালনে এত ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, স্ত্রী ভাবে—
“সে তো শুধু টাকা আনে, আমাকে আর সময় দেয় না।”
সংঘাত: ভুল বোঝাবুঝির দেয়াল
এখানেই শুরু হয় দাম্পত্য জীবনের আসল সংঘাত।
- স্বামী ভাবে: “আমি সব করছি তার সুখের জন্য।”
- স্ত্রী ভাবে: “সে আমাকে বুঝতে চায় না, ভালোবাসা দেখায় না।”
এই ভুল বোঝাবুঝি থেকেই ধীরে ধীরে তৈরি হয় আবেগের দূরত্ব।
স্ত্রীর মুড পরিবর্তন ও পুরুষের কষ্ট
স্ত্রী যখন হঠাৎ রেগে যায় বা মন খারাপ করে, স্বামী অনেক সময় বিষয়টা বুঝতে পারে না।
সে ভাবে—
আমি কি ভুল করলাম?”
“সে কি আমাকে আর ভালোবাসে না?”
কিন্তু বেশিরভাগ সময় স্ত্রী কেবল চায়—
- একটু মনোযোগ
- স্বামীর কাছ থেকে বোঝার অনুভূতি
- এক কাপ চা হাতে নিয়ে পাঁচ মিনিট গল্প
পুরুষ তখন দ্বিধায় পড়ে যায়। কারণ সে ভাবে— “আমি তো সারাদিন সংসারের জন্য দৌড়াচ্ছি, তবুও সে খুশি না।”
সমাধান: যোগাযোগ ও বোঝাপড়া
এখানে সবচেয়ে বড় সমাধান হলো খোলামেলা যোগাযোগ।
- স্ত্রী যদি নিজের অনুভূতি স্পষ্টভাবে বলে
- স্বামী যদি কেবল উপার্জনের জায়গা থেকে নয়, ভালোবাসার জায়গা থেকেও সম্পর্ককে দেখে
তাহলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
ভালোবাসা শুধু উপহার বা টাকায় নয়— সময়, মনোযোগ ও সহমর্মিতা দিয়েই প্রকাশ পায়।
একজন স্বামী সারাদিন চাকরি করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরল। স্ত্রী হয়তো অপেক্ষা করছিল তার সাথে কিছু গল্প করার। কিন্তু স্বামী মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে গেল।
স্ত্রী রেগে গিয়ে কিছু না বলে চুপ হয়ে থাকল।
স্বামী ভাবল— “সে আবার রেগে আছে কেন?”
আসলে দুজনই চাইছিল একে অপরকে, কিন্তু না বলার কারণে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হলো
পুরুষ কেবল সংসারের ঘানি টানার জন্য নয়— তারও আবেগ আছে।
নারী কেবল স্বামীর সুরক্ষার আশ্রয়ে নয়— সেও ভালোবাসা ও সম্মান চায়।
যদি দুই পক্ষই বোঝাপড়া করতে শেখে, তবে সংসার হবে শান্তির নীড়।
সমাজে পুরুষের অবস্থান ও নতুন করে ভাবার প্রয়োজন
সমাজের চোখে পুরুষ মানেই শক্তিশালী, নির্ভীক, সংসারের রোজগারদার। কিন্তু এই ধারণা এতটাই একপেশে যে, পুরুষের অনুভূতি, দুর্বলতা কিংবা মানসিক যন্ত্রণাকে কেউ তেমন গুরুত্ব দেয় না। বাস্তবতা হলো—
পুরুষরাও কাঁদে, পুরুষরাও ভাঙে, তারা-ও একা হয়ে যায়, অথচ সমাজ তাদের সেই অধিকারটুকুও দেয় না।
১. পুরুষের আবেগকে অবহেলা
- ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের শেখানো হয়, “কাঁদা মানে দুর্বলতা”, “তুমি ছেলে, শক্ত হও।”
- এর ফলে তারা তাদের কষ্ট, ভয়, ভাঙন সবকিছু বুকের ভেতর চেপে রাখতে শিখে যায়।
- একসময় সেই চাপ অদৃশ্যভাবে মানসিক যন্ত্রণায় পরিণত হয়।
২. সংসারের অদৃশ্য অবদান
- একজন পুরুষের দিন শুরু হয় ভোরে, অফিসের চাপ, বসের রাগ, বাইরের প্রতিযোগিতা—সবকিছু সামলে তাকে আবার রাতে সংসারের শান্তি ফিরিয়ে আনতে হয়।
- কিন্তু পরিবার অনেক সময় মনে করে—এ তো তার দায়িত্ব! অথচ এই দায়িত্ব পালনের পেছনে থাকে অনেক ত্যাগ, স্বপ্ন বিসর্জন, অদৃশ্য কষ্ট।
৩. নারীর মনের পরিবর্তন ও পুরুষের মানসিক চাপ
- নারীরা আবেগপ্রবণ, তাদের মনের পরিবর্তন স্বাভাবিক। তবে “সেকেন্ডে সেকেন্ড মুড চেঞ্জ” একজন স্বামীকে ভীষণ মানসিক চাপে ফেলে।
- সে বোঝাতে চায়, যত্ন নিতে চায়, কিন্তু বারবার ব্যাখ্যা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
- তখন মনে হয়—পুরুষ আসলেই কি কেবল সংসারের ঘানি টানার জন্যই জন্মেছে?
৪. নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন
- সমাজকে এখন বুঝতে হবে—পুরুষ কেবল রোজগারের মেশিন নয়, সে-ও একজন মানুষ।
- তাকে সময় দিতে হবে, তার কষ্ট শুনতে হবে, তার চোখের পানিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে।
- সংসার তখনই সুন্দর হয়, যখন স্বামী-স্ত্রী দুজনই একে অপরের মানসিক ভার ভাগাভাগি করে নেয়।
লেখক
জহুরুল ইসলাম
প্রধান সম্পাদক , বিএমএফ টেলিভিশন ।