কেন নারী ডিপ্রেশনে?

ডেস্ক রিপোর্ট। || বিএমএফ টেলিভিশন

প্রকাশিতঃ বিকাল ০৩:৩৭, বুধবার, ১ অক্টোবর, ২০২৫, ১৬ আশ্বিন ১৪৩২
ছবি: বিএমএফ টেলিভিশন।

ছবি: বিএমএফ টেলিভিশন।

ডিপ্রেশন কেবল একটি মানসিক ব্যাধি নয়, এটি এক অদৃশ্য অন্ধকার—যা ধীরে ধীরে জীবনের আনন্দ, শক্তি আর ইচ্ছাশক্তি কেড়ে নেয়। পুরুষ ও নারী উভয়েই ডিপ্রেশনে ভোগেন, তবে গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে দেয়, নারীদের মধ্যে ডিপ্রেশনের হার তুলনামূলক বেশি। প্রশ্ন হলো—কেন?
 

ডিপ্রেশন কেবল একটি মানসিক ব্যাধি নয়, এটি এক অদৃশ্য অন্ধকার—যা ধীরে ধীরে জীবনের আনন্দ, শক্তি আর ইচ্ছাশক্তি কেড়ে নেয়। পুরুষ ও নারী উভয়েই ডিপ্রেশনে ভোগেন, তবে গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে দেয়, নারীদের মধ্যে ডিপ্রেশনের হার তুলনামূলক বেশি। প্রশ্ন হলো—কেন?

১. দায়িত্ব ও প্রত্যাশার ভার

নারীকে আমাদের সমাজে জন্ম থেকে শেখানো হয়—তাকে “সহনশীল”, “ত্যাগী” ও “অন্যের জন্য বাঁচতে হবে”।
বাড়ি সামলানো, সন্তান লালনপালন, কর্মজীবনে পারফরম্যান্স—সবকিছুতেই যেন দায়িত্ব কেবল নারীর।
কিন্তু এই বাড়তি দায়িত্ব ও অবিরাম প্রত্যাশা অনেক নারীকে মানসিকভাবে ক্লান্ত করে ফেলে।

২. স্বীকৃতির অভাব

গৃহিণীর ঘরের কাজকে আমরা এখনো “কাজ” বলি না, আবার কর্মজীবী নারীকে বলা হয়—“নারী হয়েও এত কিছু করছে!”
অর্থাৎ গৃহিণীর পরিশ্রম অবমূল্যায়িত হয়, আর কর্মজীবী নারীর সাফল্যকেও পুরোপুরি স্বীকৃতি দেওয়া হয় না।
এই অবমূল্যায়ন ও স্বীকৃতির অভাব নারীর ভেতরে এক গভীর শূন্যতা তৈরি করে, যা ডিপ্রেশনের কারণ হতে পারে।

৩. সম্পর্কের টানাপোড়েন

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব, শ্বশুরবাড়ির চাপ, কিংবা পারিবারিক অশান্তি—এসব নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
অনেক নারী ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকেও বোঝাপড়া পান না, ফলে একাকীত্ব ও দুঃখ জমতে জমতে ডিপ্রেশনে রূপ নেয়।

৪. সামাজিক বাঁধন ও তুলনা

নারীকে সমাজ সর্বদা তুলনায় ফেলে—“কে কত সুন্দর?”, “কার স্বামী কত ধনী?”, “কার সন্তান কত মেধাবী?”।
অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমও এই তুলনাকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
নিজেকে সবসময় কম মনে হওয়া বা “আমি যথেষ্ট ভালো নই” ভাবনাও ডিপ্রেশনের বড় কারণ।

৫. অর্থনৈতিক ও স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা

অনেক নারী আর্থিকভাবে স্বনির্ভর নন।
নিজস্ব আয় না থাকলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতাও কমে যায়।
অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা থেকে জন্ম নেয় অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, আত্মসম্মানহীনতা—যা ডিপ্রেশনের জ্বালানি হয়ে দাঁড়ায়।

৬. শারীরবৃত্তীয় ও হরমোনজনিত প্রভাব

নারীর জীবনে মাসিক, গর্ভধারণ, সন্তান জন্ম, মেনোপজ—এসব শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন সরাসরি মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে।
হরমোনের ওঠানামা নারীর মানসিক স্বাস্থ্যে জটিলতা তৈরি করে, যা অনেক সময় ডিপ্রেশনে রূপ নেয়।

৭. সহমর্মিতার অভাব

নারী যখন বলে—“আমি ভালো নেই”—তখনও অনেকেই বলে, “এত দুর্বল কেন?”, “মন শক্ত করো”।
অথচ একজন নারী সেই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি চায় শোনা, বোঝা ও পাশে পাওয়া।
এই সহমর্মিতার অভাবও ডিপ্রেশনের গভীরতা বাড়িয়ে দেয়।


নিজেই নিজের শত্রু: নারীর ভেতরের তুলনার যুদ্ধ

ডিপ্রেশনের বড় একটি কারণ শুধু বাইরের চাপ নয়, অনেক সময় সেটা আসে নারীর ভেতর থেকেই।
আমরা সমাজে বড় হয়েছি তুলনার সংস্কৃতির মধ্যে—কে বেশি সুন্দর, কে বেশি স্লিম, কার জীবন বেশি স্বচ্ছল, কার স্বামী বেশি সফল, কার সন্তান বেশি মেধাবী।

ফলে নারী নিজের ভেতরেই এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতা শুরু করে—

“ও লম্বা, আমি খাটো।”

“ও স্লিম, আমি মোটা।”

“ওর আছে দামি গয়না, আমার নেই।”

“ও বিদেশে ঘুরতে যায়, আমি পারি না।”


এই ক্রমাগত তুলনা নারীর মনে জন্ম দেয় অযোগ্যতার বোধ।
যা হয়তো বাস্তবে সত্য নয়, কিন্তু নিজের দৃষ্টিভঙ্গিই তাকে গভীর হতাশার দিকে ঠেলে দেয়।

সামাজিক মাধ্যমে তুলনা: নতুন ফাঁদ

আজকের দিনে সামাজিক মাধ্যম এ সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
অন্যের সাজানো-গোছানো ছবি দেখে নারী ভাবে—“ওর জীবন কত সুন্দর, আমার কেন নয়?”
কিন্তু ছবির আড়ালের কষ্ট, সংগ্রাম, অশান্তি কেউ দেখে না।
ফলে নিজের বাস্তব জীবনের সঙ্গে অন্যের সাজানো ছবির তুলনা করতে গিয়ে নারী নিজেই নিজের ডিপ্রেশনের বীজ বপন করে।
নিজের প্রতি অন্যায়

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—নারী নিজের প্রতি ন্যায়বিচার করে না।
যা আছে তা নিয়ে কৃতজ্ঞ না হয়ে, যা নেই সেটাই বেশি করে ভাবতে থাকে।
একসময় সে নিজের সৌন্দর্য, প্রতিভা, যোগ্যতা সবকিছুকেই ছোট করে দেখে।
এই মানসিক অবমূল্যায়নই ডিপ্রেশনের শক্ত ভিত তৈরি করে।
সমাধান কী?

নিজেকে ভালোবাসতে শেখা: আয়নায় তাকিয়ে নিজের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া।

কৃতজ্ঞতার চর্চা: প্রতিদিন লিখে রাখা—আমার জীবনে কোন কোন জিনিসের জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

তুলনা নয়, অনুপ্রেরণা: অন্যকে দেখে হীনমন্যতায় ভোগার বদলে প্রেরণা নেওয়া।

বাস্তবতার স্বীকৃতি: কেউই নিখুঁত নয়। কারও জীবনে আলো বেশি, কারও অন্ধকার বেশি।

শেষকথা

নারীর ডিপ্রেশন কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়, এটি আমাদের সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রতিফলন।
নারীর হাসির আড়ালে যে কান্না লুকানো থাকে, তা আমাদের বুঝতে হবে।
কারণ একজন নারীর মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়া মানে শুধু একজন মানুষের ক্ষতি নয়—পুরো পরিবার, সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর এর প্রভাব পড়ে।

তাই প্রশ্ন নয়—“কেন নারী ডিপ্রেশনে?”
বরং আমাদের উত্তর খুঁজতে হবে—“কিভাবে আমরা তাকে বোঝাবো, পাশে দাঁড়াবো, তার অদৃশ্য কষ্টকে হালকা করবো?”

নারীর ডিপ্রেশন সবসময় বাইরের দোষ নয়, অনেক সময় সে নিজেই নিজের বিরুদ্ধে লড়াই করে হেরে যায়।
নিজেকে ছোট করা, অন্যের সঙ্গে তুলনা করা, যা নেই তার জন্য হাহাকার করা—এসব তাকে নিজের চোখেই অযোগ্য করে তোলে।
কিন্তু সত্যি হলো—প্রতিটি নারীই অনন্য, প্রতিটি নারীই সুন্দর, আর প্রতিটি নারীই যথেষ্ট।
লেখক৷ :শিরিন আকতার

স্বত্তাধিকারী :উড়ান
সিইও :টেস্টি বেকার্স

Share This Article

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়