সাতক্ষীরার উন্নয়ন বঞ্চনা: বিভ্রান্তিকর সংবাদে ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা

সোহারাফ হোসেন সৌরভ, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: || বিএমএফ টেলিভিশন

প্রকাশিতঃ দুপুর ১২:৪২, মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১৫ আশ্বিন ১৪৩২
ছবি: বিএমএফ টেলিভিশন।

ছবি: বিএমএফ টেলিভিশন।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় সীমান্ত জেলা সাতক্ষীরা ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও অবকাঠামোগত উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরেই বঞ্চিত। মৎস্য, কৃষি, চিংড়ি রপ্তানি ও শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও উন্নয়ন পরিকল্পনা ও সরকারি বরাদ্দে এ জেলা বারবার বৈষম্যের শিকার। রাজনৈতিক কারণে সাতক্ষীরাকে ইচ্ছাকৃতভাবে পিছিয়ে রাখা হচ্ছে—এমন অভিযোগ স্থানীয়দের মুখে প্রায়ই শোনা যায়।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় সীমান্ত জেলা সাতক্ষীরা ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও অবকাঠামোগত উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরেই বঞ্চিত। মৎস্য, কৃষি, চিংড়ি রপ্তানি ও শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও উন্নয়ন পরিকল্পনা ও সরকারি বরাদ্দে এ জেলা বারবার বৈষম্যের শিকার। রাজনৈতিক কারণে সাতক্ষীরাকে ইচ্ছাকৃতভাবে পিছিয়ে রাখা হচ্ছে—এমন অভিযোগ স্থানীয়দের মুখে প্রায়ই শোনা যায়।

সম্প্রতি সরকারের একটি উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের খবর সাতক্ষীরার মানুষের মধ্যে আশার আলো জাগিয়েছিল। কিন্তু দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো-তে প্রকাশিত একটি সংবাদে জেলার বাস্তব চিত্র বিকৃতভাবে তুলে ধরা হয়েছে বলে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বাড়ি সাতক্ষীরায় হওয়ায় এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সড়কসংক্রান্ত তথ্যও প্রকাশ করা হয়েছে ভিন্নভাবে, যা সরকারি তথ্যের সঙ্গে মেলে না।

সরকারি তথ্য বনাম বিভ্রান্তিকর উপস্থাপন

সরকারি হিসাব অনুযায়ী সাতক্ষীরায় মোট ৫৭৮৮টি সড়ক রয়েছে, যার দৈর্ঘ্য ১১,০০২.৪৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে মাত্র ২২৩০.৩১ কিলোমিটার (২০.২৭%) পাকা এবং ৮৭৭২.১৫ কিলোমিটার (৭৯.৭৩%) কাঁচা। অথচ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে—মোট সড়ক ৯২৯৪ কিলোমিটার, যার মধ্যে ৩৩৩৯ কিলোমিটার পাকা এবং ১০৫০ কিলোমিটার সড়কে সংস্কারকাজ চলছে। বাস্তবে সংস্কার হচ্ছে মাত্র ১৯.২৭ কিলোমিটার সড়কে। অর্থাৎ, প্রকৃত অবস্থা আড়াল করে জেলার উন্নয়ন চিত্র বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

বরাদ্দের বৈষম্য-

সাতক্ষীরায় উন্নয়ন বরাদ্দের চিত্রও হতাশাজনক। গত চার অর্থবছরে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ এসেছে এক-তৃতীয়াংশেরও কম।

২০২২-২৩ অর্থবছরে চাহিদা ছিল ১০৬.৪৬ কোটি, বরাদ্দ এসেছে মাত্র ৪১.৪৩ কোটি (৩৯.০৫%)।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১১৮.৭৬ কোটির বিপরীতে বরাদ্দ ৪১.১৮ কোটি (৩৪.৬৭%)।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১২৮.৭৬ কোটির বিপরীতে বরাদ্দ ৪৪.১২ কোটি (৩৪.২৭%)।

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১৪৩.৯৭ কোটির বিপরীতে বরাদ্দ মাত্র ৪০.৫১ কোটি (২৮.১৪%)।


এমন বৈষম্য স্থানীয়দের ক্ষুব্ধ করেছে। তাদের প্রশ্ন—সাতক্ষীরার উন্নয়ন কি ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে দেওয়া হচ্ছে?

দুর্যোগপ্রবণ জেলা, সংকটে মানুষ

সাতক্ষীরা সীমান্ত জেলা হওয়ার পাশাপাশি উপকূলীয় দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙন এখানে বারবার আঘাত হানে। বিশেষ করে আশাশুনি ও শ্যামনগরের দুর্গম জনপদে অধিকাংশ সড়ক এখনও কাঁচা। দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে লবণাক্ত পানি ঢুকে যায় ঘরবাড়ি ও ফসলের জমিতে। মাছের ঘের ভেসে যায়, মানুষ হয় বাস্তুচ্যুত। বিশুদ্ধ পানির অভাবে নারীদের প্রতিদিন দূরদূরান্তে হাঁটতে হয়। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

শিক্ষা এগিয়েছে, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগে পিছিয়ে

সাতক্ষীরা শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ অবকাঠামো ভয়াবহভাবে পিছিয়ে। গত ১৭ বছরে একটি মাত্র মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রেল যোগাযোগ নেই, নৌপথ কার্যকর নয়। রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। বাইপাস সড়ক ছাড়া উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন দৃশ্যমান নয়। অথচ এ জেলা থেকে সরকার চিংড়ি, কৃষি ও বনসম্পদসহ বিভিন্ন খাতে বিপুল রাজস্ব আয় করে। স্থানীয়দের ক্ষোভ—“আয় হয় সাতক্ষীরা থেকে, ব্যয় হয় অন্যত্র।”

রাজনৈতিক ট্যাগিং ও বঞ্চনা

স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজনৈতিক ট্যাগিংয়ের কারণে সাতক্ষীরাকে দীর্ঘদিন উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অথচ এ জেলার মানুষ শান্তিপ্রিয়, পরিশ্রমী এবং রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছেন প্রতিনিয়ত। রাজনৈতিক অপপ্রচারের ফলেই অবকাঠামো ও যোগাযোগ খাতে সাতক্ষীরা পিছিয়ে পড়েছে।

বিশেষ উন্নয়ন প্যাকেজের দাবি

বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ মানুষ মনে করেন, সাতক্ষীরার জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি বিশেষ উন্নয়ন প্যাকেজ প্রয়োজন।

সড়ক ও যোগাযোগ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত,

দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ,

শক্তিশালী বেড়িবাঁধ স্থাপন,

লবণাক্ততা মোকাবিলায় বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা,

রেল ও নৌপথ সংযোগ স্থাপন—এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ।


উপসংহার

বাংলাদেশের অর্থনীতি, কৃষি ও শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সাতক্ষীরার উন্নয়ন কেবল এখানকার মানুষের অধিকার নয়, বরং জাতীয় অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। বাস্তবতা বিবর্জিত সংবাদ প্রকাশ শুধু সাতক্ষীরার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে না, বরং দীর্ঘদিনের উন্নয়ন বঞ্চনার বেদনা আরও বাড়িয়ে তুলছে।

সাতক্ষীরাবাসীর একটাই প্রত্যাশা—ন্যায্য উন্নয়ন প্রাপ্যতা নিশ্চিত হোক, যেন সীমান্ত ও উপকূলের এই সম্ভাবনাময় জেলা আর বঞ্চিত না হয়।

Share This Article

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়