ডিপ্রেশন: নীরব এক মহামারি

ডেস্ক রিপোর্ট। || বিএমএফ টেলিভিশন

প্রকাশিতঃ দুপুর ১২:২৯, শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১২ আশ্বিন ১৪৩২
ছবি: সংগৃহীত।

ছবি: সংগৃহীত।

মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখের ওঠানামা স্বাভাবিক। কিন্তু যখন দুঃখ, হতাশা ও নিরাশা দীর্ঘসময় ধরে মনে জায়গা করে নেয়, তখন সেটি হয়ে ওঠে এক অদৃশ্য শৃঙ্খল, যা মানুষকে ধীরে ধীরে ভেতর থেকে ভেঙে ফেলে। এই অদৃশ্য শত্রুর নাম ডিপ্রেশন।

মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখের ওঠানামা স্বাভাবিক। কিন্তু যখন দুঃখ, হতাশা ও নিরাশা দীর্ঘসময় ধরে মনে জায়গা করে নেয়, তখন সেটি হয়ে ওঠে এক অদৃশ্য শৃঙ্খল, যা মানুষকে ধীরে ধীরে ভেতর থেকে ভেঙে ফেলে। এই অদৃশ্য শত্রুর নাম ডিপ্রেশন।

আজকের দিনে ডিপ্রেশন কেবল একটি ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, বরং একটি সামাজিক সংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ৩০ কোটির বেশি মানুষ ডিপ্রেশনে আক্রান্ত। বাংলাদেশও এই সংকট থেকে মুক্ত নয়। তবে দুঃখজনকভাবে, আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য এখনো ট্যাবু, লজ্জা, কিংবা উপহাসের বিষয় হিসেবেই থেকে গেছে।


ডিপ্রেশন কেবল মন খারাপ নয়

আমাদের সমাজে এখনো অনেকে মনে করেন, ডিপ্রেশন মানে “অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা” কিংবা “অলসতা।” কিন্তু ডিপ্রেশন চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একটি গুরুতর মানসিক ব্যাধি।
এর লক্ষণগুলোও সহজভাবে ধরা যায় না—

দীর্ঘস্থায়ী দুঃখ, হতাশা ও নিরাশা

প্রিয় কাজগুলোতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা

ঘুমের সমস্যা বা অতিরিক্ত ঘুম

ক্ষুধা কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া

মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা

“আমি মূল্যহীন” বা “আমি অপ্রয়োজনীয়” এমন ভাবনা

চরম ক্ষেত্রে আত্মহত্যার চিন্তা


এই লক্ষণগুলো শুধু মানসিক কষ্টই নয়, শারীরিক ও সামাজিক জীবনে ভীষণ প্রভাব ফেলে।

একটি গল্প

ঢাকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী— সাথী (ছদ্মনাম)। সবাই তাকে চিনত প্রাণবন্ত, সবসময় হাসিখুশি একজন হিসেবে। কিন্তু সেই হাসির আড়ালে চলত এক নীরব যুদ্ধ। পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফল না পাওয়া, পরিবারের চাপ, আর চারপাশের মানুষের উচ্চ প্রত্যাশা তার ভেতরটাকে ভেঙে দিয়েছিল। রাতে ঘুমানোর আগে ডায়েরিতে লিখত— “আমি আর পারছি না।”

সবাই ভেবেছিল ওর সবকিছু ঠিক আছে। কারণ সে তো আড্ডায় হাসত, সবার সাথে সময় কাটাত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে একা হয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্যক্রমে এক শিক্ষক তার পরিবর্তন লক্ষ্য করেন এবং তাকে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান। নিয়মিত থেরাপি আর কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সাথী ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। এখন সে নিজেই অন্যদের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার কাজে যুক্ত হয়েছে।

সাথীর গল্প আমাদের শেখায়— ডিপ্রেশন কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। আর বোঝাপড়া ও সময়মতো সহায়তাই পারে একটি জীবনকে ফের নতুন আলোয় ফিরিয়ে আনতে।


কেন হয় ডিপ্রেশন?

ডিপ্রেশনের কারণ একক নয়, বরং বহুমাত্রিক।

পারিবারিক সমস্যা: ভাঙা সম্পর্ক, দাম্পত্য কলহ, বা শৈশবের মানসিক আঘাত।

সামাজিক চাপ: বেকারত্ব, আর্থিক অনিশ্চয়তা, অথবা পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের প্রতিযোগিতা।

ব্যক্তিগত কারণ: জেনেটিক প্রভাব, হরমোনের পরিবর্তন, শারীরিক অসুস্থতা।

আধুনিক জীবনযাত্রা: একাকীত্ব, প্রযুক্তিনির্ভর জীবন, সামাজিক মাধ্যমে তুলনা ও অপ্রাপ্তি।


বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, এবং সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাও ডিপ্রেশনের বড় কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।


আমাদের সমাজের বাস্তবতা

বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা এখনো লজ্জাজনক বা দুর্বলতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। একজন যদি বলে— “আমি ভালো নেই”, তখন আশেপাশের মানুষ উত্তর দেয়—

“তুমি এত দুর্বল কেন?”

“মন শক্ত করো।”

“এগুলো কিছুই না, দোয়া-দরুদ পড়ো, সব ঠিক হয়ে যাবে।”


অবশ্যই ধর্মীয় অনুশাসন অনেককে মানসিক শান্তি দেয়, কিন্তু চিকিৎসার বিকল্প নয়। ডিপ্রেশনের মতো মানসিক ব্যাধির জন্যও যেমন ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রে চিকিৎসক লাগে, তেমনি প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ সহায়তা।

কিন্তু সমস্যা হলো— দেশে প্রশিক্ষিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও কাউন্সেলরের সংখ্যা অপ্রতুল। সরকারি হাসপাতালে কিছু সেবা থাকলেও তা অপর্যাপ্ত। ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসা নিতে গেলে খরচের বোঝা অনেকের জন্যই অসহনীয়। ফলে অনেকেই নীরবে ভেঙে পড়েন।

করণীয়

ডিপ্রেশনকে অবহেলা করলে শুধু একজন মানুষ নয়, একটি পরিবার, এমনকি সমাজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই প্রয়োজন—

১. পরিবারে খোলামেলা আলোচনা: সন্তান বা প্রিয়জনের মন খারাপ হলে বিচার না করে শোনার চেষ্টা করতে হবে।


২.শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে সহায়তা: কাউন্সেলিং সেন্টার চালু করা জরুরি।


৩.সরকারি উদ্যোগ: গ্রামীণ পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে হবে।


৪. গণমাধ্যম ও সামাজিক প্রচার: মানসিক স্বাস্থ্যকে লজ্জার বিষয় নয়, বরং স্বাভাবিক রোগ হিসেবে তুলে ধরতে হবে।


৫. ব্যক্তিগত সহমর্মিতা: কারো মুখে “আমি ভালো নেই” শুনলে উপদেশ নয়, বরং পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।


শেষকথা

ডিপ্রেশন অদৃশ্য, কিন্তু ভয়াবহ বাস্তব। বাইরে থেকে যাকে স্বাভাবিক মনে হয়, সে হয়তো ভেতরে প্রতিদিন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছে। আমাদের একটু বোঝাপড়া, একটু সহমর্মিতা, আর সঠিক সময়ে সাহায্য— হতে পারে কারো জীবনে নতুন করে বেঁচে ওঠার আলো।

ডিপ্রেশন কোনো লজ্জার বিষয় নয়। এটি একটি রোগ— যার চিকিৎসা আছে, সমাধান আছে। শুধু প্রয়োজন আমরা যেন তাদের শুনি, বুঝি, আর পাশে থাকি।।।

 

লেখক: 

শিরিন আকতার 
স্বত্তাধিকারী : উড়ান
সিইও: টেস্টি বেকার্স

Share This Article

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়