ঢাকা শহরে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য

জহুরুল ইসলাম : || বিএমএফ টেলিভিশন

প্রকাশিতঃ সকাল ১০:৫১, বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ৯ আশ্বিন ১৪৩২
ছবি: বিএমএফ টেলিভিশন।

ছবি: বিএমএফ টেলিভিশন।

ঢাকা শহর শুধু বাংলাদেশের রাজধানী নয়, এটি দেশের প্রাণকেন্দ্র। প্রতিদিন লাখো মানুষ কাজের সন্ধানে, ব্যবসা-বাণিজ্যে কিংবা বিভিন্ন প্রয়োজনে এখানে ভিড় জমায়। কিন্তু এই নগর জীবনের ব্যস্ততা ও জটিলতার মাঝেই দিন দিন বেড়ে চলেছে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য। রাস্তায়, গলিতে, বাসস্ট্যান্ডে, ফুটওভার ব্রিজে এমনকি রিকশা বা প্রাইভেটকারে যাতায়াত করার সময়ও মানুষ আজ নিরাপদ বোধ করছে না।

 

ঢাকা শহর শুধু বাংলাদেশের রাজধানী নয়, এটি দেশের প্রাণকেন্দ্র। প্রতিদিন লাখো মানুষ কাজের সন্ধানে, ব্যবসা-বাণিজ্যে কিংবা বিভিন্ন প্রয়োজনে এখানে ভিড় জমায়। কিন্তু এই নগর জীবনের ব্যস্ততা ও জটিলতার মাঝেই দিন দিন বেড়ে চলেছে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য। রাস্তায়, গলিতে, বাসস্ট্যান্ডে, ফুটওভার ব্রিজে এমনকি রিকশা বা প্রাইভেটকারে যাতায়াত করার সময়ও মানুষ আজ নিরাপদ বোধ করছে না।

ছিনতাই এখন আর রাতের অন্ধকারে সীমাবদ্ধ নেই। দিনের আলোতেও নির্দ্বিধায়, প্রকাশ্যে ছিনতাই হচ্ছে। এতে শুধু সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, সমাজের মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী সবাই আতঙ্কে ভুগছে। মানুষ রাস্তায় বের হওয়ার আগে আজ আর শুধু যানজটের চিন্তায় নয়, ছিনতাইয়ের ভয়েও ভীত থাকে।

নিরাপত্তাহীনতার এ বাস্তবতায় অনেকের মধ্যে প্রশ্ন জাগছে -ঢাকা শহরে কি সাধারণ নাগরিকদের জীবন এখন এতটাই অসহায় হয়ে পড়েছে?

ঢাকায় ছিনতাইয়ের ধরন-

ঢাকা শহরে ছিনতাই একটি বহুমাত্রিক অপরাধে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন কৌশল, বিভিন্ন সময় ও ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ছিনতাইকারীরা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ছিনতাইয়ের ধরন মূলত কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়।

১. রাস্তার ছিনতাই:

ঢাকার রাস্তাঘাটে, বিশেষ করে ব্যস্ত মোড়, ফুটওভার ব্রিজ, রিকশা কিংবা পায়ে হাঁটার সময় অনেক মানুষ ছিনতাইয়ের শিকার হয়। ছিনতাইকারীরা হঠাৎ করে এসে মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ, চেইন, ব্যাগ টেনে নিয়ে পালিয়ে যায়। ভিড়ের মাঝে হঠাৎ এ ধরনের হামলা অনেক সময় প্রাণঘাতী আঘাতেও পরিণত হয়।

২. যানবাহনে ছিনতাই:

সাধারণ বাসে যাত্রীরা প্রায়ই ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে। গ্যাং সদস্যরা যাত্রী সেজে ওঠে, তারপর সুযোগ বুঝে টাকা-পয়সা, মোবাইল কেড়ে নেয়। কখনও অস্ত্র দেখিয়ে ভীতি সৃষ্টি করে পুরো বাস নিয়ন্ত্রণে নেয়।

রিকশা কিংবা সিএনজি চালিত অটোরিকশায় চলার সময়ও যাত্রীরা নিরাপদ নন। একা বা কম যাত্রী থাকলে ছিনতাইকারীরা দলবেঁধে হামলা চালায়।

৩. রাতের ছিনতাই:

রাতের বেলায় অফিস থেকে ফেরার সময় বা দীর্ঘ দূরত্বে যাতায়াতকারীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। অন্ধকার গলি, নির্জন সড়ক কিংবা ব্রিজ এলাকায় দলে দলে ছিনতাইকারীরা অবস্থান নেয়। অনেকে মোটরসাইকেল ব্যবহার করে দ্রুত ছিনতাই করে পালিয়ে যায়।

৪. প্রতারণার মাধ্যমে ছিনতাই:

সাম্প্রতিক সময়ে প্রতারণার কৌশল ব্যবহার করে ছিনতাই বেড়েছে। যেমন—অপরিচিত কেউ হঠাৎ অসুস্থ হওয়ার ভান করে, বা দিকনির্দেশনা চেয়ে দাঁড় করায়, সুযোগ বুঝে মোবাইল বা টাকা নিয়ে পালায়।

৫. অনলাইন বা অ্যাপ-ভিত্তিক ছিনতাই:

এখনকার সময়ে ফেসবুক, অনলাইন মার্কেটপ্লেস কিংবা রাইডশেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহার করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ফেক আইডি বা ভুয়া অর্ডার দিয়ে মানুষকে নির্জন স্থানে ডেকে নিয়ে অস্ত্রের মুখে সব কেড়ে নেয়।
বর্তমান পরিস্থিতি-

ঢাকার প্রায় সব থানা এলাকাতেই ছিনতাইকারীর তৎপরতা রয়েছে।

মোহাম্মদপুর ,ধানমন্ডি , কাকলী, বনানী ফ্লাইওভার, উত্তরা , তুরাগ ,মহাখালী, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, মিরপুর রোড,  গুলিস্তান, সদরঘাট ও সায়েদাবাদ এবং রামপুরা বনশ্রী এলাকাগুলো ছিনতাইয়ের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত ।

ঢাকার অনেক ভুক্তভোগী পুলিশের কাছে অভিযোগই করেন না, কারণ তারা জানেন মামলা করলেও অধিকাংশ সময় ছিনতাইকারীরা আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে।

ছিনতাই বৃদ্ধির কারণ-

১. অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বেকারত্ব:

ঢাকায় প্রতিদিন অসংখ্য বেকার যুবক কাজের খোঁজে ঘোরাফেরা করে। কাজ না পেয়ে অনেকেই সহজে অর্থ রোজগারের জন্য অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে।

২. মাদকাসক্তি:

অধিকাংশ ছিনতাইকারী মাদকাসক্ত। ইয়াবা, গাঁজা, ফেন্সিডিল কিংবা আইসের নেশা মেটাতে তারা ছিনতাই করে থাকে।

৩. আইনের দুর্বল প্রয়োগ:

ছিনতাইয়ের অভিযোগে গ্রেপ্তার হলেও অনেক অপরাধী রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে শাস্তি এড়িয়ে যায়। এতে অন্যদেরও উৎসাহিত করে।

৪. জনসংখ্যার চাপ:

ঢাকার জনসংখ্যা এত বেশি যে, পুলিশের পক্ষে প্রতিটি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। জনবহুল এলাকায় অপরাধীরা সহজেই মিশে যায়।

৫. প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ:

বর্তমানে ছিনতাইকারীরা শুধু অস্ত্র বা হঠাৎ আক্রমণেই সীমাবদ্ধ নয়। ভুয়া রাইডশেয়ারিং অ্যাপ, নকল সিএনজি, কিংবা জাল মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপ ব্যবহার করেও মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে।

ছিনতাইয়ের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব-

মানসিক ভীতি: মানুষ রাত-বিরাতে রাস্তায় বের হতে ভয় পাচ্ছে।

অর্থনৈতিক ক্ষতি: সাধারণ মানুষ তাদের জমানো টাকা, গহনা, মোবাইল ফোন হারাচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

আইনের প্রতি অনাস্থা: ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার পর পুলিশে গিয়ে প্রতিকার না পেলে মানুষের মনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থা কমে যায়।

শহরের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত: বিদেশি নাগরিক, প্রবাসী ও পর্যটকরা ঢাকার নিরাপত্তাহীন পরিবেশ দেখে আতঙ্কিত হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা-

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) নিয়মিত বিশেষ অভিযান চালালেও ছিনতাই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে:

সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন

পুলিশের রাত্রিকালীন টহল বৃদ্ধি

র‌্যাবের বিশেষ অভিযান

বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও এয়ারপোর্ট এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি

তবে এসব উদ্যোগও দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হতে পারছে না, কারণ অপরাধীদের একটি বড় অংশ পুনরায় জেল থেকে বের হয়ে এসে একই অপরাধে জড়িয়ে যায়।

প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা-

১. আইনের কঠোর প্রয়োগ:

ছিনতাইকারীদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

মাদক নিয়ন্ত্রণ:

মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করতে হবে। কারণ মাদকই ছিনতাইয়ের অন্যতম মূল চালিকা শক্তি।

প্রযুক্তি ব্যবহার:

শহরের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা ও ফেস-রিকগনিশন টেকনোলজি বসাতে হবে।

জনসচেতনতা:

মানুষকে সাবধান থাকতে হবে। রাতে একা রাস্তায় হাঁটা, অপরিচিত গাড়িতে ওঠা বা মোবাইল ফোন খোলা জায়গায় ব্যবহার কমাতে হবে।

বেকারত্ব দূরীকরণ:

তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। চাকরি বা ব্যবসার সুযোগ থাকলে তারা অপরাধে জড়াবে না।

কমিউনিটি পুলিশিং:

প্রতিটি ওয়ার্ডে স্থানীয় মানুষকে যুক্ত করে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যকর করা গেলে ছিনতাই প্রতিরোধ সহজ হবে।

ঢাকা একটি জনবহুল ও ব্যস্ত নগরী। এখানে ছিনতাই পুরোপুরি নির্মূল করা হয়তো সম্ভব নয়, তবে শক্ত হাতে আইন প্রয়োগ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা গেলে এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। প্রতিদিন যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ শেষে ঘরে ফেরেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্র ও সমাজের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।

লেখক,

জহুরুল ইসলাম 
প্রধান সম্পাদক 
বিএমএফ টেলিভিশন

Share This Article

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়