প্রফেসর জিল্লুর রহমান একটি প্রদীপের নির্বাপণ, একটি আলোর অনন্ত যাত্রা...
আব্দুল্লাহ আল মামুন , হরিনাকুন্ড উপজেলা প্রতিনিধি || বিএমএফ টেলিভিশন
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও যোগাযোগ বিভাগের শ্রদ্ধেয় প্রফেসর, রিজেন্ট বোর্ডের সম্মানিত সদস্য, ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা, অসামান্য গবেষক এবং মানবিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ এক মহামানব—প্রফেসর ড. মোঃ জিল্লুর রহমান—আজ আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন।ভোরের নরম আলো ফোটার আগেই, আজ ৩ জুন ২০২৫ (মঙ্গলবার) সকাল ৫টা ৫ মিনিটে রাজধানীর ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বিগত কিছুদিন ধরে ফুসফুসের ক্যান্সার ও নিউমোনিয়ায় ভুগছিলেন এই মহান শিক্ষক, মানবিক বাতিঘর। কিন্তু আমরা কি জানতাম—এই কয়েকটি দিনই ছিল আমাদের প্রিয় জিল্লু ভাইয়ের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ, শেষ প্রার্থনা, শেষ ভালোবাসার শেষ অধ্যায়?আজ সারাদিন, যেন কিছুই করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কেউ হৃদয়ের গভীরে হাত ঢুকিয়ে কেঁদে উঠেছে—বুকের মধ্যে একটা ফাঁকা গর্ত, নিঃশব্দে হাহাকার করে যাচ্ছে। সেই চেনা মুখ—মিষ্টি হাসি, কোমল কণ্ঠ, নিরহংকার উপস্থিতি—বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। বুকের ভেতরে কান্না জমে উঠছে, যেন আপন ভাই হারানোর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছি আমরা প্রত্যেকে। কানে বাজছে তার সাথে ফোন কলে বলা শেষ কথাগুলো মুজাহিদ কেমন আছো, আমি তো বেশি অসুস্থ নয়, ফেসবুকে পোস্ট করেছো আমার অসুস্থতা নিয়ে সবাই ফোন করছে? পোস্ট ডিলিট করে দাও, আমি চিকিৎসায় তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাব ইনশাআল্লাহ। আমার জন্য দোয়া করো। আহা ভাই এই কথাগুলোই যে শেষ কথা হবে কে জানতো!
জন্ম এবং আলোকিত যাত্রা:
১৯৭৭ সালের ১৯ জুন, ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার ভায়না গ্রামে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি ছিলেন এক অপার সম্ভাবনার নাম। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে আশাবাদী, সবচেয়ে পরিশ্রমী, সবচেয়ে মানবিক মুখ।ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে বিএ (সম্মান) ও এমএ সম্পন্ন করেন (১৯৯৪–১৯৯৫)। এরপর ২০০৯ সালে “Shakespearean Tragedies and Social Realism” শীর্ষক গবেষণায় এমফিল এবং ২০২২ সালে “The Second Generation English Romantic Poets and Kazi Nazrul Islam: A Comparative Study” বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করেন—যা একাডেমিক জগতকে সমৃদ্ধ করেছে।২০০৭ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, ধাপে ধাপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং শেষে অধ্যাপক পদে। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা, শ্রদ্ধার্হ ব্যক্তিত্ব, ও কর্তব্যনিষ্ঠার জন্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন শিক্ষার্থী, সহকর্মী, এবং সমাজের কাছে এক আলোকবর্তিকা।
মাঠে-ময়দানে মানুষের পাশে, চুপিচুপি দেবতার মতো
যে মানুষটি ক্লাসরুমে ছিলেন প্রজ্ঞার প্রতীক, তিনি জীবনের বাইরেও ছিলেন মানবিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত ঝিনাইদহের গরিব ছাত্রছাত্রীদের জন্য নিজের অর্থে বই, খাতা, টিউশন ফি, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ফিসহ যাবতীয় সাহায্য করতেন, যেন একজন শিক্ষক নয়—একজন অভিভাবক হয়ে উঠতেন। দলমত, ধর্ম-বর্ণ নয়, তার কাছে ছিল শুধু মানুষ—আর সেই মানুষদের পাশে দাঁড়ানোই ছিল তার একমাত্র ব্রত।একটা কথাও নেই যেটা মিথ্যে—তিনি কারও কাছ থেকে কোনোদিন ফিরিয়ে দেননি। তার দ্বার ছিল খোলা, তার মন ছিল প্রশান্ত এক হ্রদের মত সবকিছুকে আপন করে নেওয়ার মতো উদার।
চিরতরে নীরব হলেন এক জ্ঞানতাপস:
তার গবেষণার বিষয়গুলো ছিল ঠিক ততটাই বিস্তৃত, যতটা বিস্তৃত ছিল তার মন—শেক্সপিয়র থেকে শুরু করে নজরুল, রোমান্টিক কবিতা থেকে ইকো-পোয়েট্রি, মানবাধিকার থেকে সাহিত্য ও শিক্ষার নতুন পদ্ধতি—সবকিছুতেই তিনি রেখেছেন অনন্য অবদান। দেশি-বিদেশি ২০টিরও বেশি গবেষণাপত্র তার আলোকিত চিন্তাধারার স্বাক্ষর।
একটি মুখ, এক হৃদয়, এক প্রার্থনার মানুষ
তার ব্যক্তিগত জীবন ছিল নীরব, কিন্তু অনুকরণীয়। একজন বিনয়ী, সহিষ্ণু, সদালাপী মানুষ হিসেবে যারা তাকে কাছ থেকে চেনেন, তারা জানেন—তার মতো পবিত্র হৃদয়ের মানুষ এ যুগে বিরল। মৃত্যুর আগে শেষ যে শব্দটি তিনি উচ্চারণ করেন, তা ছিল—"লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ"—একটি আত্মার চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ, এক অন্তর থেকে নিঃসৃত ঈমানের শুদ্ধতম বহিঃপ্রকাশ।তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস, কোরআন হাফেজ এবং নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক পুত্র এবং প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক কন্যাকে। পিতার নাম মোঃ শামসুল হক, মাতা বিলকিস বেগম—যারা গড়েছেন এক মহামানবের ভিত্তি।
শেষ বিদায়, কিন্তু চিরন্তন ভালোবাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, “ড. জিল্লুর রহমান ছিলেন এক অনন্য আলোকিত মানুষ। তাঁর মৃত্যু আমাদের পরিবারের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা তাঁর জ্ঞান, মমতা ও প্রজ্ঞা আজীবন মনে রাখব।”প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এস. এম. হেমায়েত জাহান স্মরণ করে বলেন, “তাঁর প্রতিটি ক্লাস, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি হাসি শিক্ষার্থীদের জন্য ছিল এক আশার আলো। তিনি আমাদের হৃদয়ের শিক্ষক।”
একটি সমাপ্তি নয়, একটি শুরু:
প্রিয় জিল্লুর ভাই, আপনি চলে গেছেন। কিন্তু আপনার রেখে যাওয়া আলো নিভে যায়নি। আপনি ছিলেন—আপনি আছেন—আপনি থাকবেন। আমাদের চোখের জলে, আমাদের হৃদয়ের হাহাকারে, আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে আপনি চিরজীবিত।আপনার মতন মানুষ মারা যান না, তারা রূপান্তরিত হন—ভালোবাসায়, স্মৃতিতে, এবং ভালো কাজে। আমাদের পথ চলায়, সংকটে, শিক্ষায়, নীতিতে, আপনার আদর্শ হবে নকশা।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি—তিনি যেন আপনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন এবং আপনার স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনদের এই অপূরণীয় শোক সহ্য করার শক্তি দান করেন।ভালো থাকুন, জিল্লু ভাই।
আপনার স্নিগ্ধ মুখ, কোমল হাসি, নিরহংকার হৃদয় আর মানবিক কর্মকাণ্ডের স্মৃতি আমাদের চিরকাল আলো দেখাবে।