মুজিবনগরে স্কুল, মাদ্রাসা, বৃদ্ধাশ্রমের নামে সরকারি বরাদ্ধের চাল নিয়ে চালবাজি
রাশেদ খান, মেহেরপুর || বিএমএফ টেলিভিশন
মেহেরপুরের মুজিবনগরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে সরকারি বরাদ্দে চাল নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। স্কুল, মাদ্রাসা, ধর্মীয় উপাসানালায় এমনকি বৃদ্ধাশ্রমের নামে সরকারি বরাদ্ধের চাল নিয়ে করা হয়েছে চালবাজি। আর এসব অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে মুজিবনগর উপজেলা সাবেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মাশরুবা আলমের বিরুদ্ধে। যে পরিমাণ চাল ঐসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানবিক সহায়তা কর্মসূচির অংশ হিসেবে বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে তার সিঁকিভাগও পাই নি ঐসব প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে ঐসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে ক্ষোভের দানা বেঁধেছে। সরজমিন অনুসন্ধানে এসব অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে।
সরজমিনে মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান আমিমীয়া খানকা শরীফ হাফিজিয়া মাদ্রাসায় গিয়ে দেখা যায়। একটি টিন সেডের ঘরে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা কষ্ট করে লেখাপড়া করছে। ২০২৪ সালের ১৯ জুন মানবিক সহায়তা কর্মসূচির অংশ হিসেবে সরকারিভাবে এই মাদ্রাসার নামে বাগোয়ান ইউপি সদস্য আব্দুর রকিবের নামে বরাদ্ধ দেওয়া হয় ৫ মে.টন চাল। অথচ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তার কিছুই জানে না। কোন সহায়তা পাই নি তারা। এমনকি ঐ জনপ্রতিনিধি আব্দুর রকিবও জানেন না কিছুই। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে কেদারগঞ্জ বাজারে দারুল উলম মাদানিয়া কাওমী মাদরাসা ও লিল্লাহ বোডিং নামের মাদ্রাসায় বরাদ্ধ আসে ৫ মে.টন চাল। অথচ ওই মাদ্রাসায় দেওয়া হয়েছে মাত্র ৪২ হাজার ৫০০ টাকা। ২৬ জুন ২০২৩ সালে বল্লভপুর মিশন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নামে বরাদ্ধ দেওয়া হয় ৫ মে.টন (জি আর) চাল। কিন্তু তিনি পেয়েছেন মাত্র ৪০ হাজার টাকা। বাকী বরাদ্ধের টাকা কে কিভাবে তুলে নিয়েছেন তা জানা নেই তাদেরও। বল্লভপুর হাসপাতালের বৃদ্ধাশ্রম, ক্যাথলিক চার্চ, মহিলা কমিটি চার্চ অব বাংলাদেশ, প্রেস বিটারিয়ান চার্চ বল্লভপুরসহ ২০২৪ সালে ৬টি প্রতিষ্ঠানের নামে মোট ২৮ মে.টন চাল বরাদ্ধ দেওয়া হয়। পৃথক ২০২৩ সালে আরো দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে ১০ মে.টন চাল বরাদ্ধ দেওয়া হয়। সরজমিন অনুসন্ধানে ২০২৩/২৪ সালে ৮টি প্রতিষ্ঠানে সরকারি বরাদ্ধের চাল নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। এসব অনিয়মে বিষয়ে মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানগুলো। বাগোয়ান আমিমীয়া খানকা শরীফ হাফিজিয়া মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ কাজী সাইফুল্লাহ জানান, কাগছে দেখছি আমাদের মাদ্রাসার নামে বরাদ্ধ এসেছে কিন্তু আদ্যেও আমরা এই বরাদ্দের বিষয়ে কিছুই জানি না এবং আমরা কিছুই পাই নি। যদি কেউ অবৈধভাবে এই টাকা উত্তোলন করে থাকে তার সুষ্ট বিচার চাই আমরা। এর আগেও আমরা শুনেছি অনেক প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্ধের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। দারুল উলম মাদানিয়া কাওমী মাদরাসা ও লিল্লাহ বোডিং মাদ্রাসার শিক্ষক ও ক্যাশিয়ার আমিনুল ইসলাম বলেন, আমাদের মাদ্রাসার নামে ৫ মে.টন চাল বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে কিন্তু আমরা তো ৫ মে.টন চালের টাকা পাই নি। আমরা ৪২ হাজার ৫০০ টাকা পেয়েছি। উপজেলা থেকে টাকা তুলে এনেছি। কত টাকা আমাদের বরাদ্ধ এসেছে তা বলা হয় নি। বল্লভপুর মিশন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মি: লুক হরেন বিশ^াস বলেন, আমাকে উপজেলা থেকে ডাকা হয় এবং ৪০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এখন তারা কোন খাত থেকে আমাদের টাকা দিয়েছে আমাদের ধারণা ছিল না, আমরা জানিও না। এই টাকা আমার স্কুলের উন্নয়নে ব্যয় করি। আমরা ৪০ হাজার টাকা ছাড়া কিছুই পাই নি। যারা এই বরাদ্ধের চাল নিয়ে অনিয়ম করেছে তারা অবশ্যই দোষী। সঠিক বিষয়টি তদন্তের মাধ্যমে তুলে আনা প্রয়োজন। বল্লবপুর মহিলা কমিটি চার্চ অব বাংলাদেশের পরিচালক মঞ্জু মল্লিক বলেন, আমরা তো বয়স্ক মহিলাদের নিয়ে কাজ করি। যখন শুনলাম বরাদ্ধের কথা তখন আবেদন করি। আমি ৪০ হাজার টাকা পেয়েছি। আমরা খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু যখন শুনলাম আমাদের নামে বরাদ্ধ আছে ৫.মে টন চাল। তখন আমরা অবাক হই। সবাই বলছে আমরা এই টাকা তুলে নিয়েছি। কিন্তু এই ৫.মে টন চালের বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। আমাদের কিছুই বলা হয় নি। আমাদের জন্য এটি খুবই দুঃখের বিষয়। বল্লভপুর হাসপাতালের প্রশাসক মি: আলফ্রেড বিনিময় বিশ^াস বলেন, আামাদের বল্লভপুর হাসপাতালের বৃদ্ধাশ্রমের জন্য ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। সেটির রশিদ রয়েছে। কিন্তু অনেকে বলছে ৫ মে.টন চাল পেয়েছি আমরা। এটি আমাদের জন্য সম্মান হানীকর। আমাদের এটি সুপরিচিত এবং সেবামূলক মানবিক প্রতিষ্ঠান। বাগোয়ান ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য আব্দুর রকিব বলেন, আমার নামে মাদ্রাসায় ৫ মে.টন বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। যখন কাগজে দেখতে পাই তখন অবাক হয়েছি। টিআর কাবিখার কাগজে সই করতে গিয়ে তখন ঐ বরাদ্ধের কাগজে মাশরুবা আলম আমার সই করে নিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের নামে আমাকে কোন টাকাই দেওয়া হয় নি। আমি এর সুষ্ট বিচার চাই। বাগোয়ান ইউনিয়ন পরিষদের আরেক ইউপি সদস্য বাবুল মল্লিক বলেন, রুমের মধ্যে সাবেক উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মাশরুবা আলম একাই ছিলেন এবং যাদের নামে বরাদ্ধ এসেছে তাদের একে একে ডেকে নিজ হাতে টাকা দিয়েছেন। তিনি একটি কাগজে লিখেও রেখছিলেন। তখন চাল বরাদ্ধের বিষয়ে কোন আলোচনা হয় নি। একটি প্রতিষ্ঠান অর্থ সহায়তা পাচ্ছে, হয়ত এটাই আমার প্রাপ্য, এটিই বড় কিছু এটিই আমরা মনে করেছি। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানই সামাজিক এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। সম্পূর্ণ বরাদ্ধটুকু পেলে তো প্রতিষ্ঠানের জন্য উপকার হতো। এখানে যে অনিয়ম হয়েছে তার সুষ্ট তদন্ত হওয়া উচিৎ। আমি কোন কাগজে সই করি নি এমনকি বরাদ্ধের বিষয়ে কোন কিছু বলা হয় নি। সাবেক মুজিবনগর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মাশরুবা আলম বলেন, নিয়ম মেনেই ঐসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবকিছু দেওয়া হয়েছে। তাদেরতো এখন না করার সুযোগ নেই। ঐ সময় যদি তারা ভুল করে থাকে তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পলাশ মন্ডল বলেন, ভুক্তভোগি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্ত শেষ হলে যারা এর সাথে জড়িত আছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যাবস্থা গ্রহন করা হবে।