‘পশ্চিম তীরে খোলা আকাশের নিচে বিস্তৃত এক কারাগার’

আন্তর্জাতিক সংবাদ || বিএমএফ টেলিভিশন

প্রকাশিতঃ রাত ১২:৩৪, শনিবার, ২৪ মে, ২০২৫, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
সংগ্রহ ছবি

সংগ্রহ ছবি

কখনো কখনো ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আটকে থাকি : পশ্চিম তীরে কিছু রাস্তা কেবল ইসরাইলিদের জন্য বরাদ্দ। প্রায় ৭৯ কিলোমিটার রাস্তা আছে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের চলাচল নিষিদ্ধ। কেউ সেখানে গেলে তাকে জরিমানা, গ্রেফতার এমনকি হামলার মুখে পড়তে হতে পারে। বাকি পথগুলো দিয়েও পারাপার সহজ নয়। পশ্চিম তীরের বাসচালক রাকান সাঈদ বলেছেন, আমরা কখনো কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকি ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাস্তায় আটকে থাকি। আমরা পুরো দিনের আয় হারিয়ে ফেলি। নাবলুস থেকে রামাল্লাহ যেতে যেখানে এক ঘণ্টা লাগত, সেখানে এখন লাগে ছয় ঘণ্টা। এ সময়ে সেখান থেকে প্যারিসে যাওয়া যায় বলেও আক্ষেপ করেন রাকান। এ ধরনের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা ফিলিস্তিনিদের জন্য এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
 

 

পশ্চিম তীর শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, খোলা আকাশের নিচে যেন এক বিস্তৃত কারাগার। যার প্রাচীর এখন দেখা যায় না। কিন্তু আগ্রাসি বিষে বিষাক্ত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের ছোট-বড় প্রতিটি অঙ্গই ইসরাইলের নিষ্ঠুর সামরিক চেকপয়েন্টে বাধ। সব মিলিয়ে ৮৯৮টি। যেখানে লাখ লাখ ফিলিস্তিনির পৃথিবী দিনের আলো ফোটার আগেই থমকে যায়! চেকপয়েন্টগুলোর সামনে দাঁড়ানো মানেই অনির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষা, ইচ্ছাধীন তল্লাশি, কখনো অপমান, সেই সঙ্গে নির্যাতন। রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে ফটকে। স্কুলের সময় পেরিয়ে গেছে, তবুও মেলেনি সেনাদের অনুমতি। সরানো হয়নি বাধা। পশ্চিম তীরজুড়েই ছড়িয়ে আছে এই অদৃশ্য শিকল, যেখানে প্রতিদিনই ফিলিস্তিনিরা নিয়ম করে ‘বন্দি’ থাকেন।
বছরের পর বছর চেকপয়েন্টের নামে ইসরাইলি দখলদারির ভয়ংকর এ কারাগারেই কয়েদি হয়ে আছে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর। আলজাজিরা, মিডল ইস্ট মনিটর, ওয়াফা। দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিম তীর দখলে বসতি ঔপনিবেশিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে ইসরাইলি বাহিনী। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে তারা এখন চেকপয়েন্ট স্থাপনকে প্রধান নিয়ন্ত্রণ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে।
গত কয়েক দশকে ৫ হাজার ৬৫৫ বর্গকিলোমিটারের পশ্চিম তীরে (অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমসহ) ইসরাইলি বসতি বিস্তার, বাইপাস সড়ক নির্মাণ এবং দখলকৃত এলাকায় প্রাচীর তুলে দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক হারে সামরিক চেকপয়েন্ট স্থাপন করেছে দখলদার সেনারা।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় গণহত্যামূলক অভিযান শুরুর পর থেকে পশ্চিম তীরে আরও নতুন নতুন মেটাল ডিটেক্টর গেট এবং স্থায়ী ও অস্থায়ী সামরিক চেকপয়েন্ট স্থাপন করেছে।
ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংস্থার (পিসিএইচআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারির পর থেকে ইসরাইলি বাহিনী পশ্চিম তীরে নতুন ১৭টি মেটাল ডিটেক্টর গেট এবং অসংখ্য অস্থায়ী চেকপয়েন্ট স্থাপন করেছে।
বর্তমানে মোট চেকপয়েন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৯৮টিতে। যার মধ্যে হেবরনে ২২৯, রামাল্লাহ ও আল-বিরেহেতে ১৫৬, নাবলুসে ১৪৭, জেরুজালেমে ৮২, বেইত লাহমে ৬৫, কালকিলিয়ায় ৫৩, সালফিতে ৫০, তুবাসে ৩৩, জেরিখোয় ৩২, তুলকারেমে ২৭ এবং জেনিনে ২৪টি চেকপয়েন্ট রয়েছে। চেকপয়েন্টগুলো শহর-গ্রামের প্রবেশপথ এবং প্রধান সড়কগুলোয় ছড়িয়ে পড়ায় চলাচল আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। অঞ্চলগুলো কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নিজ শহরেই বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা।
শুধু বন্দিত্বই নয়, গাজার মতোই মৃত্যুর আতঙ্কে জীবন কাটছে পশ্চিম তীরের বাসিন্দাদেরও। গাজার মতো বিমান-কামান-ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে না পড়লেও প্রতিদিনই ইসরাইলের সেনা-দখলদারদের বুলেটে ঝরছে পশ্চিম তীরের নিরপরাধ প্রাণ। অধিকার গোষ্ঠীটি আল-হকের বরাতে এদিন আলজাজিরা জানিয়েছে, ২০২৫ সালের ২১ জানুয়ারি থেকে ১৬ মে ১২০ দিনে পশ্চিম তীরে ১৩ শিশু, তিন নারীসহ ৯১ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরাইলি বাহিনী। একই সঙ্গে জেনিন, তুলকারেম, তুবাস ও নাবলুসে ব্যাপকভাবে অবকাঠামো ও ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে। কমপক্ষে ৪৩০টি স্থাপনা ধ্বংস করেছে তারা। উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার বাসিন্দা।
চেকপয়েন্ট পাড়ি দেওয়া এখন জীবনের বড় যুদ্ধ: আহমেদ হাসান নামের এক নাগরিক ফিলিস্তিনি মানবাধিকার সংস্থার এক গবেষককে বলেছেন, আমি ইসরাইলে কাজ করি, আমার স্ত্রী বেইত হানিনা এলাকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। আমর সন্তানরাও ওই স্কুলেই পড়াশোনা করছে। যেটি আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্বে। অথচ আমরা প্রতিদিন ভোর সাড়ে ৩টার দিকে ঘুম থেকে উঠি। ৪টা নাগাদ বাসা ছেড়ে বের হয়ে পড়ি। কারণ, ৫টার পর থেকেই ‘জাবা’ চেকপয়েন্টে ভয়াবহ যানজট শুরু হয়। ১০ মিনিটের পথ পেরোতেই আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যায়। বাসায় ফিরতে ফিরতে দুপুরের খাবারের সময়ও চলে যায়। শুধু রাতে ঘুমানোর সময়টুকুই বাড়িতে কাটাতে পারি। এ যানজট আমাদের জীবনে এক ধরনের কারাবন্দি দশা এনে দিয়েছে। চেকপয়েন্ট পেরোনো এখন আমাদের জীবনের বড় যুদ্ধ। মানসিকভাবে আমরা সবাই বিপর্যস্ত।
হেবরন যেন গুয়ান্তানামো কারাগার: পশ্চিম তীরের হেবরনের মেয়র তায়সির আবু সনেইহ বলেছেন, এ শহরকে রীতিমতো গুয়ান্তানামো বে কারাগারে পরিণত করেছে ইসরাইল। সাধারণ মানুষকে সম্মিলিতভাবে শাস্তি দিচ্ছে তারা। ইসরাইলি সেনারা পশ্চিম তীরের দক্ষিণের শহর হেবরনে সব রাস্তাঘাটে কঠোর চেকপয়েন্ট আর লোহার গেট বসিয়ে ফিলিস্তিনিদের চলাচল সীমিত করেছে। এখন শহরের সব প্রবেশপথ বন্ধ। বাজারগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। পরিবহণব্যবস্থা থমকে গেছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে গেছে।
বসতি স্থাপনকারীদের হামলার ঝুঁকি: ফিলিস্তিনিদের চলার পথে শুধু চেকপয়েন্টই বাধা নয়, ইসরাইলি সেনাদের মদদপুষ্ট বসতি স্থাপনকারীরাও তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইসরাইল যে জমি দখল করেছে, সেখানে বসতি গড়ে তুলেছেন দেশটির নাগরিকরা। এ বসতি স্থাপনকারীরা প্রায়ই ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালায়। গাড়িচালক আতিয়াত বলেন, ‘একা চালালে আমরা বেশি বিপদের মধ্যে পড়ি। তিনটি বা এর বেশি গাড়ি একসঙ্গে চললে বসতি স্থাপনকারীরা হামলা করতে সাহস পায় না।’
হামলার ঝুঁকি এড়াতে আতিয়াত ও অন্য চালকরা এখন একসঙ্গে গাড়ি চালান। চেকপয়েন্ট ছাড়াও ফিলিস্তিনিদের বাড়িতে গিয়েও আক্রমণ চালায় বসতি স্থাপনকারীরা। শুক্রবার এএফপি জানিয়েছে, অধিকৃত পশ্চিম তীরের ব্রুকিনে রাতভর আক্রমণ চালিয়েছে সেখানকার বসতি স্থাপনকারীরা। এসময় ফিলিস্তিনিদের বেশকিছু গাড়ি পুড়িয়ে দেয় তারা।
প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা: ওয়ালিদ হুসেইন ছিলেন পশ্চিম তীরের নাবলুসের আইন বেইত আল-মা শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা। এখন সেই শিবিরের দেওয়ালে এবং রাস্তাঘাটের কোণে কোণে তার স্মরণে পোস্টার ও ব্যানার ঝুলছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ইসরাইলি সেনারা ওয়ালিদকে তার গাড়ি থেকে নামিয়ে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। ২০২২ সালের শেষদিকে নাবলুস গভর্নরেটের শহর দেইর শরাফে একটি চেকপয়েন্ট বসানো হয়। সেখানে এ ধরনের সহিংসতা সাধারণ সিষয় হয়ে উঠেছে। দেইর শরাফের মেয়র শাদি আবু হালাওয়েহ বলেছেন, এ চেকপয়েন্টে এখন পর্যন্ত দুজনকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া সেনাদের সহিংসতায় গুরুতর আহত হয়েছেন আরও ৩ জন।
ভয়াবহ হয়রানির শিকার নারী: ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীরের হেবরন শহরের বিভিন্ন চেকপয়েন্টে প্রতিদিনই ভয়াবহ হয়রানির শিকার হচ্ছেন ফিলিস্তিনি নারীরা। চেকপয়েন্টে নারীদের বারবার তল্লাশির নামে অসম্মান করে বর্বর সেনারা। স্থানীয় নারীরা জানিয়েছেন, শারীরিক ও মৌখিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন তারা। তল্লাশির নামে অনেক সময় তাদের পোশাক বা হিজাব খুলতে বাধ্য করা হয়। জোরপূর্বক নারীদের ব্যক্তিগত ছবি তুলে তাদের হেনস্তা করা হয়। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এ অভিজ্ঞতা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।
ভোগান্তি কমাতে অ্যাপের আশ্রয়: ইসরাইলি বাধা আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিজেদের চলার পথ খুঁজে নিচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। ভোগান্তি কমাতে নিজেদের তৈরি মোবাইল অ্যাপ দরুব ন্যাভিগেটর ও আজমেহ ব্যবহার করছেন তারা। এসব অ্যাপের মাধ্যমে কোন রাস্তায় চেকপয়েন্ট, কোথায় জ্যাম, আর কোনদিকে বিকল্প পথ খোলা আছে এসব তথ্য মুহূর্তেই জানতে পারেন তারা। আর সে পথেই ছুটে চলেন দল বেঁধে। আজমেহ অ্যাপটি ২০১৫ সালে চালু হয়। ইসরাইলের হুমকিতে বন্ধ হলেও ২০২৩ সালের মার্চে আবারও চালু হয় অ্যাপটি। এখন এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭০ হাজারের কাছাকাছি। যুদ্ধের প্রথমদিকে প্রতিদিন প্রায় ৮ হাজার ফিলিস্তিনি এটি ইনস্টল করেছিলেন।

 

Share This Article

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়