টেকনাফে গুলি করে জেলে হত্যার পর লাশ গুমের অভিযোগে

রফিক মাহমুদ, উখিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি || বিএমএফ টেলিভিশন

প্রকাশিতঃ রাত ১২:১৪, বুধবার, ২১ মে, ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
ধারণকৃত ছবি

ধারণকৃত ছবি

কক্সবাজারের টেকনাফে কোস্টগার্ডের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে গুলি করে মোহাম্মদ তাহের (৪০) নামে এক জেলেকে হত্যার পর লাশ গুম করার অভিযোগ উঠেছে। সে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড নতুন পল্লানপাড়া এলাকার আব্দুল জলিলের ছেলে। তিনি নৌকার মাঝি ও মালিক ছিলেন। স্ত্রী রফিকা বেগম ও তাহের দম্পতির ২ ছেলে ও ৫ মেয়ে সন্তান রয়েছে। 

 

নিহতের পরিবারের দাবি, কোস্টগার্ডের গুলিতে নিহত ব্যক্তি জেলে এবং কোস্টগার্ড সদস্যরাই নিহতের মরদেহ নিয়ে যেতে দেখেছেন তারা। মরদেহ ফেরতের দাবি জানান।   

বড় ভাই মোহাম্মদ কাছিম বলেন, ঘটনার দিন রাতে ছোটভাই মোহাম্মদ তাহের সহ ৭জন মাঝিমাল্লা নিয়ে টেকনাফ সদরের তুলাতলী ঘাট দিয়ে সাগরের মাছ শিকারে যেতে রওয়ানা হয়। এসময় কোস্টগার্ড সামনে পড়লে মাছ শিকারের কথা বলে। এক থেকে দুই মিনিট যেতে না যেতেই সাগরে থাকা কোস্টগার্ড ও কুলে থাকা কোস্টগার্ড  সদস্যরা জেলেদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় এতে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নৌকায় পড়ে যায়।

তাহের ও শুক্কুর গুলিবিদ্ধ হয়। ঘটনাস্থলে তাহের মারা যান। এসময়  আরও তিনজন পালিয়ে গেলেও মো. ইলিয়াস ওরফে রিয়াজ (৩০), নুর মোহাম্মদ (৬১) ও গুলিবিদ্ধ আবদুল শুক্কুর (৪০) আটক করে। পরে মৃত মোহাম্মদ তাহেরের লাশটি প্যাকেটে ভরে একটি অটোরিকশায় তুলে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে শাহপরীর দ্বীপের দিকে নিয়ে যায়।  

প্রত্যক্ষদর্শী আলী হোসেন,ঘটনার সময় একটু অন্ধকার ছিল। ভোরের আলো উকি দিচ্ছিল। এসময় কোস্টগার্ডের পোশাক ও সাদা পোশাকে কিছু লোকজন গুলিতে নিহত তাহেরর লাশটি প্যাকেটে ভরে অটোরিকশা তুলে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে নিয়ে যেতে শত শত লোকজন দেখেছেন। পরের কোস্টগার্ড সদস্যরা তাদের গাড়ি থেকে ইয়াবা ও অস্ত্র নিয়ে নৌকা দিয়ে সেগুলো উদ্ধারের ভিডিও চিত্র ধারণ করেন।   

রাতে আটক ছেলে মো. ইলিয়াস ওরফে রিয়াজ দেখতে টেকনাফ থানা হাজতে যান মা গোলবাহার বেগম (৭৫) ও বড় ভাবি তৈয়ুবা বেগম (৩৫)। ওই সময় মা গোলবাহার বেগমকে তাহেরে লাশ দাফন করা হয়েছে কিনা জানতে চাই। বাহির হয়ে আসে গোপন তথ্য-কাহিনী। 

মা গোলবাহার বেগম বলেন,তোমার মেজভাইয়ের কি হয়েছে জানতে চাই। তখন পুলিশ হেফাজতে থাকা ছোট ভাই মো. ইলিয়াস ওরফে রিয়াজ বলেন,ঘটনার সময় কোস্টগার্ডের গুলিতে মেজভাই   মারা গেছে। ওই সময় আব্দুল শুক্কুর গুলিবিদ্ধ হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোস্টগার্ড নিহত তাহেরের লাশ ফেরত দেয়নি।  

গত সোমবার কোস্টগার্ডের অভিযান টেকনাফে বিদেশি পিস্তল, গুলি, মাদকসহ তিনজন আটক, একজন গুলিবিদ্ধ’ শিরোনামে বিভিন্ন পত্রিকা বা অনলাইনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। 

টেকনাফের তুলাতলী ঘাট এলাকায় ইঞ্জিনচালিত একটি কাঠের নৌকা থেকে ১টি বিদেশি পিস্তল, ৪টি গুলি, ৩০ হাজার ইয়াবা বড়িসহ তিনজনকে আটক করেছে কোস্টগার্ড। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। গত রোববার রাত আড়াইটার দিকে কোস্টগার্ড অভিযান চালিয়ে ওই তিনজনকে আটক করে।

আটক তিনজন হলেন কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা মো. ইলিয়াস (৩০), নুর মোহাম্মদ (৬১) ও আবদুল শুক্কুর (৪০)। তাঁদের মধ্যে আবদুল শুক্কুর গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাঁকে চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

কোস্টগার্ড জানিয়েছে, সাগরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই একটি নৌকা দেখতে পেয়ে রাতে থামার সংকেত দেয় কোস্টগার্ড। এসময় নৌকায় থাকা ব্যক্তিরা কোস্টগার্ডের দিকে গুলি ছুড়ে নৌকা নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কোস্টগার্ডও আত্মরক্ষার্থে পালটা গুলি চালিয়ে নৌকাটিকে ধাওয়া করে। প্রায় এক ঘণ্টা পর নৌকাটি জব্দ করতে সক্ষম হয় কোস্টগার্ড। নৌকা থেকে গুলিবিদ্ধ একজনসহ তিনজনকে আটক করা সম্ভব হলেও আরও চারজন সাগরে লাফ দিয়ে সাঁতরে পালিয়ে গেছেন। নৌকায় তল্লাশি করে ১টি বিদেশি পিস্তল, ৪টি গুলি ও ৩০ হাজার ইয়াবা বড়ি পাওয়া যায়।

কোস্টগার্ড মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হারুন-অর-রশীদ অভিযানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন,আটক তিনজনই মাদক কারবারি।তাঁদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক রিয়াদ সাঈদ চৌধুরী বলেন, সোমবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে গুলিবিদ্ধ শুক্কুরকে কোস্টগার্ড সদস্যরা হাসপাতালে নিয়ে আসে। তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পিঠে গুলিবিদ্ধ শুক্কুরের অবস্থা শঙ্কাজনক।

গুলিতে নিহত তাহেরের পরিবারের দাবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কোস্টগার্ড মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হারুন-অর-রশীদ বলেন, এটি মিথ্যা বানোয়াট। আমরা ঘটনাস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ আব্দুল শুক্কুর ও মো. ইলিয়াস (৩০), নুর মোহাম্মদ (৬১) নামে তিনজনকে ১টি বিদেশি পিস্তল, ৪টি গুলি ও ৩০ হাজার ইয়াবাসহ আটক করেছি।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত  কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা (ওসি তদন্ত) হিমেল রায় বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমাদের কাছে কোন ধরনের অভিযোগ করা হয়নি।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগটি পাওয়ার পর কোস্ট গার্ডের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা গুলিবিদ্ধ একজনসহ তিনজনকে আটক করেছেন। হত্যা করে লাশ গুমের অভিযোগটি  অস্বীকার করেছেন। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অবহিত করা হয়েছে।  

লাশ ফেরত চেয়ে মানববন্ধন করেছে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থী ও ভুক্তভোগী পরিবার । কক্সবাজারের টেকনাফ কোস্টগার্ডের গুলিতে  নিহত জেলে মোহাম্মদ তাহেরের লাশ ফেরত চেয়ে মানববন্ধন করেছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি ও ভুক্তভোগী পরিবার।

মঙ্গলবার দুপুর ২ টা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত টেকনাফ বাস স্টেশন ঝরনা চত্বরে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ব্যাপী বাস স্টেশন এলাকার সড়ক বন্ধ করে দিয়ে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হওয়ায় উভয় পাশে শত শত যানবাহন আটকা পড়েন। 

এ সময় বক্তব্য রাখেন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের প্রতিনিধি মোরশেদ আলম, ইয়াসিন আরাফাত, জুবায়ের আজিজ, সাইফুল ইকবাল, মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, আতাউল্লাহ কাদেরী, নিহতের পরিবারের গুলবাহার বেগম, বড় ভাই মো. কাছিম ও মেয়ে আছিয়া বেগম।

বক্তারা বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিহতের লাশ ফেরত চেয়েছেন। পাশাপাশি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করেছেন এবং অন্যথায় টেকনাফ অচল করে দেওয়ার  হুমকি দেওয়া হয়েছে।

Share This Article

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়