সাংবাদিক কি নাগরিক নন?

জহির তারেক। || বিএমএফ টেলিভিশন

প্রকাশিতঃ সন্ধ্যা ০৬:৪৩, শনিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫, ৫ পৌষ ১৪৩২
ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

রাষ্ট্র যখন একটি পেশাকে নীরবে ‘নিষিদ্ধ তালিকায়’ ফেলে দেয়

রাষ্ট্র যখন একটি পেশাকে নীরবে ‘নিষিদ্ধ তালিকায়’ ফেলে দেয়

একটি রাষ্ট্র কতটা সভ্য, কতটা আত্মবিশ্বাসী—তা বোঝা যায় সে রাষ্ট্র তার সমালোচকদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে।
বাংলাদেশে সেই পরীক্ষায় রাষ্ট্র ক্রমশ অস্বস্তিকর জায়গায় দাঁড়াচ্ছে।

কারণ, এই দেশে আজ শুধু সাংবাদিকতা করা কঠিন নয়—
সাংবাদিক হিসেবে বেঁচে থাকাই ক্রমশ অসম্ভব হয়ে উঠছে।

বাসা ভাড়া নিতে গেলে সমস্যা।
ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে গেলে সমস্যা।
ক্রেডিট কার্ড নিতে গেলে সমস্যা।
ভিসা আবেদন করলে জটিলতা।
বিয়ে করতে গেলেও আপত্তি।
গ্রেপ্তার হলে কারাগারে নিরাপত্তা নেই।

একটা প্রশ্ন তাই অনিবার্য—

সাংবাদিক কি এই রাষ্ট্রের পূর্ণ নাগরিক নন?

পেশার নাম শুনেই কেন ভ্রু কুঁচকে যায়?

এই দেশে আপনি যদি বলেন—ডাক্তার, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা—
তাহলে দরজা খোলে।

কিন্তু যদি বলেন—“আমি সাংবাদিক”,
তাহলে দরজা পুরোপুরি বন্ধ না হলেও
চোখে-মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এই ভয়টা ব্যক্তির প্রতি নয়।
এই ভয়টা পেশার প্রতি।

এবং এই ভয় রাষ্ট্রই তৈরি করেছে।

বাসা ভাড়া: সাংবাদিক কি অবাঞ্ছিত ভাড়াটে?

আজ শহরাঞ্চলের বহু বাড়িওয়ালা খোলাখুলি বলেন—
“সাংবাদিকদের বাসা দিই না।”

কেন?

কারণ তারা ধরে নেয়—
• সাংবাদিক নিয়ম জানে
• সাংবাদিক প্রশ্ন করে
• সাংবাদিক অন্যায় দেখলে চুপ থাকে না

অর্থাৎ, সাংবাদিক ঝামেলাবিহীন মানুষ নয়—এই ধারণা।

প্রশ্ন হলো—
নিয়ম জানা আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে থাকা কবে থেকে অপরাধ হয়ে গেল?

ব্যাংকিং সেবা: সাংবাদিক কি আর্থিকভাবে অবিশ্বাস্য?

ব্যাংক একাউন্ট খুলতে গেলে বাড়তি কাগজ।
ক্রেডিট কার্ডে অদৃশ্য বাধা।
লোনে অলিখিত না।

ব্যাংকগুলোর যুক্তি—
“সাংবাদিকদের আয় অনিশ্চিত।”

কিন্তু বাস্তবতা বলছে—
• ফ্রিল্যান্স আইটি কর্মীর আয়ও অনিশ্চিত
• ব্যবসায়ীর আয়ও ঝুঁকিপূর্ণ
• শেয়ার ব্যবসায়ীর আয়ও ওঠানামা করে

তবু তারা সেবা পায়।

তাহলে সমস্যা আয় নয়।
সমস্যা পরিচয়।

ব্যাংক ভয় পায়—
এই মানুষটি নিয়ম জানে, প্রশ্ন তুলতে পারে, প্রয়োজনে প্রকাশ্যে কথা বলতে পারে।

ভিসা ও আন্তর্জাতিক যাতায়াত: সন্দেহের চোখে সাংবাদিক

ভিসা আবেদন করলে সাংবাদিকদের প্রায়ই পড়তে হয়—
• অপ্রয়োজনীয় ইন্টারভিউ
• অতিরিক্ত কাগজপত্র
• অযৌক্তিক প্রশ্ন

কারণ কী?

কারণ রাষ্ট্র নিজেই আন্তর্জাতিক পরিসরে সাংবাদিককে উপস্থাপন করেছে—
একজন সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ নাগরিক হিসেবে।

এটা কি দেশের সম্মান বাড়ায়?
নাকি রাষ্ট্রের দুর্বলতাই প্রকাশ করে?

বিয়ে: যখন পেশা হয়ে ওঠে সামাজিক বাধা

সবচেয়ে করুণ বাস্তবতা—
বিয়ে করতে গেলেও সাংবাদিক পরিচয় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

অনেক পরিবার স্পষ্টভাবে বলে—
• চাকরি অনিশ্চিত
• ঝুঁকি বেশি
• মামলা-হামলার ভয়

প্রশ্ন হলো—
রাষ্ট্র যদি একটি পেশাকে এমন অবস্থায় ফেলে দেয়,
যে পেশার মানুষ সামাজিক সম্পর্ক গড়তেও বাধার মুখে পড়ে—
তবে সেটা কি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা নয়?

কারাগারে সাংবাদিক: সবচেয়ে ভয়াবহ বার্তা

এই সম্পাদকীয়তে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি এখানে।

এই দেশে একজন সাংবাদিক গ্রেপ্তার হলে—
তাকে অনেক সময় স্পেশাল ফাঁসির আসামি বা কুখ্যাত অপরাধীদের সেলে রাখা হয়।

এটা কাকতালীয় নয়।
এটা অবহেলা নয়।
এটা একটি নীরব ভয় দেখানো।

এই বার্তাটা পরিষ্কার—

“তুমি সাংবাদিক।
তুমি নিরাপদ নও।”

এই একটি আচরণই সমাজকে শেখায়—
সাংবাদিক মানেই ঝুঁকি।

ফলে বাড়িওয়ালা ভয় পায়।
ব্যাংক ভয় পায়।
পরিবার ভয় পায়।

রাষ্ট্রই সাংবাদিককে ঝুঁকিপূর্ণ বানিয়েছে।

আইনের প্রশ্ন: কোন বিধিতে এটা বৈধ?

স্পষ্ট করে জানতে চাই—
• কোন আইনে লেখা আছে সাংবাদিককে ফাঁসির আসামির পাশে রাখার অনুমতি?
• কোন মানবাধিকার নীতিতে এটা বৈধ?
• কোন সভ্য রাষ্ট্রে এটা গ্রহণযোগ্য?

উত্তর যদি না থাকে,
তবে এই আচরণ অবৈধ, অমানবিক ও রাষ্ট্রবিরোধী।

তাহলে সোজা সিদ্ধান্ত নিন: নিষিদ্ধ করুন

এখানে রাষ্ট্রের কাছে একটি কঠিন কিন্তু যৌক্তিক প্রস্তাব—

যদি রাষ্ট্র মনে করে—
• সাংবাদিক ঝুঁকিপূর্ণ
• সাংবাদিক অবিশ্বাস্য
• সাংবাদিক সমস্যা তৈরি করে

তাহলে সাহস করে ঘোষণা দিন—
এই দেশে সাংবাদিকতা নিষিদ্ধ।

আড়ালে রেখে শাস্তি নয়।
অঘোষিত বৈষম্য নয়।
সরাসরি বলুন—

“আমরা প্রশ্ন চাই না।”

কারণ অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা
ঘোষিত নিষেধাজ্ঞার চেয়েও বেশি কাপুরুষতা।

রাষ্ট্র কি ভুলে যাচ্ছে সাংবাদিক না থাকলে কী হয়?

সাংবাদিক দুর্বল হলে শক্তিশালী হয়—
• দুর্নীতি
• দখলদারি
• ক্ষমতার অপব্যবহার

আজ যাদের সাংবাদিক “ঝামেলা” মনে হয়,
কাল তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

রাষ্ট্রকে এই সত্য বুঝতে হবে—
সাংবাদিক রাষ্ট্রের শত্রু নয়, আয়না।


সরকারের উচ্চ মহলের প্রতি চূড়ান্ত দাবি

এই সম্পাদকীয় থেকে স্পষ্টভাবে দাবি জানানো হচ্ছে—
1. সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সব ধরনের পেশাভিত্তিক বৈষম্য নিষিদ্ধ করতে হবে
2. ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সমান সেবা নিশ্চিত করতে হবে
3. ভিসা ও আন্তর্জাতিক যাতায়াতে অঘোষিত বাধা বন্ধ করতে হবে
4. কারাগারে সাংবাদিকদের জন্য লিখিত নিরাপত্তা প্রোটোকল চালু করতে হবে
5. সাংবাদিকদের জন্য ন্যূনতম আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে

এই সিদ্ধান্ত না নিলে—
রাষ্ট্র নিজেই স্বীকার করবে—
সে প্রশ্নকে ভয় পায়।

 

শেষ কথা: আয়না ভাঙলে মুখ বদলায় না

সাংবাদিকরা কোনো বিশেষ সুবিধা চায় না।
তারা চায়—
সমান নাগরিক মর্যাদা।

রাষ্ট্র যদি আজও সাংবাদিক পরিচয়ে ভ্রু কুঁচকাতে দেয়,
তবে কাল রাষ্ট্রকেই আয়নার সামনে দাঁড়াতে ভয় লাগবে।

কারণ আয়নায় তখন দেখা যাবে—
একটি রাষ্ট্র,
যে প্রশ্নকে ভয় পায়,
আর ভয় পেলে সভ্যতা টেকে না।

Share This Article

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়