চুরি হচ্ছে বিরল প্রাণী, পাচার হচ্ছে প্রতিবেশী দেশে

ডেস্ক রিপোর্ট। || বিএমএফ টেলিভিশন

প্রকাশিতঃ দুপুর ০১:৩১, শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৫, ২৩ কার্তিক ১৪৩২
ছবি: সংগৃহীত।

ছবি: সংগৃহীত।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে বিরল প্রজাতির প্রাণী। পাচারকারীরা প্রথমে অনলাইনে প্রাণীর ছবি প্রচার করে ক্রেতা সংগ্রহ করে। দাম ঠিক করে তারপর প্রাণী চুরি করে পৌঁছে দেওয়া হয় ক্রেতাদের কাছে। সম্প্রতি গাজীপুর সাফারি পার্ক থেকে রিংটেইলড লেমুর চুরির ঘটনা তদন্তে নেমে এ তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে বিরল প্রজাতির প্রাণী। পাচারকারীরা প্রথমে অনলাইনে প্রাণীর ছবি প্রচার করে ক্রেতা সংগ্রহ করে। দাম ঠিক করে তারপর প্রাণী চুরি করে পৌঁছে দেওয়া হয় ক্রেতাদের কাছে। সম্প্রতি গাজীপুর সাফারি পার্ক থেকে রিংটেইলড লেমুর চুরির ঘটনা তদন্তে নেমে এ তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে আফ্রিকার দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কার থেকে দুটি প্রতিষ্ঠান আমদানি, সংরক্ষণ এবং বিক্রয় নিষিদ্ধ দুটি রিংটেইলড লেমুরসহ ৮৬ জোড়া প্রাণী আমদানি করা হয়। পরে প্রাণীগুলো রাখা হয় গাজীপুর সাফারি পার্কে। সাফারি পার্কে লেমুরের দুটি বাচ্চার জন্ম নিলে মোট চারটি লেমুরের আবাসন হয় পার্কে। এর মধ্যে একটি লেমুর মারা যায়।

গত ২৩ মার্চ রাতে গাজীপুর সাফারি পার্কের নিরাপত্তাবেষ্টনী কেটে বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির দুটি পুরুষ এবং একটি স্ত্রী রিংটেইলড লেমুর চুরির ঘটনা ঘটে। 
সিআইডির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গাজীপুর সাফারি পার্কের আউটসোর্সিং কর্মী নিপেল মাহমুদ এই চুরির ঘটনায় জড়িত। পার্কের ভেতরে তিনি বিভিন্ন দুর্লভ, বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণীর ছবি এবং ভিডিও ধারণ করতেন। সে ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের প্রাইভেট গ্রুপ ও পেজগুলোয় পোস্ট করে দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন।

ক্রেতাদের কোনো প্রাণী পছন্দ হলে দরদাম করে মূল্য নির্ধারিত হলে পছন্দকৃত প্রাণী চুরি করতেন তিনি। 
জানা যায়, ২৩ মার্চ ভোরে নিরাপত্তাবেষ্টনী কেটে বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির তিনটি রিংটেইলড লেমুর চুরি করে প্রতিবেশী মো. জুয়েল মিয়ার বাড়িতে রাখেন। এর মধ্যে একটি রিংটেইলড লেমুর দেলোয়ার হোসেন তাওসীফ এবং মো. সাব্বির হোসেন তপনের কাছে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন নিপেল মাহমুদ। আরো দুটি লেমুর আছে জানতে পেরে তারা দুজন ভারতীয় ক্রেতার সঙ্গে ৭ লাখ টাকায় বিক্রির জন্য মধ্যস্থতা করে দেয়। পরে দেলোয়ার হোসেন তাওসীফ ও সাব্বির হোসেন তপন দুজন ভারতীয় ক্রেতাসহ ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকা থেকে দুটি লেমুর কার্টনে ভরে ক্রেতাদের গাড়িতে তুলে দেন।

এসময় নিপেলকে ৭০ হাজার টাকা কমিশন হিসেবে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীমউদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গাজীপুর সাফারি পার্কটিতে আউটসোর্সিংয়ে কাজ করা নিপেল মাহমুদ মূলত আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী চুরি ও পাচার চক্রের সদস্য। পার্কের কর্মী হওয়ার সুযোগে খুব সহজেই বিরল প্রজাতির প্রাণীর ছবি ও ভিডিও ধারণ করে আন্তর্জাতিক বাজারে ছড়িয়ে দিতেন নিপেল। পরে দরদাম চূড়ান্ত হলে পার্কে সংরক্ষিত বন্যপ্রাণী চুরি করে আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের হাতে তুলে দিতেন। নিপেলসহ এ চক্রের গ্রেপ্তার হওয়া ছয় সদস্যই আদালতে দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। চুরি যাওয়া মোট তিনটি রিংটেইলড লেমুরের মধ্যে একটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, বাকিগুলো উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। প্রতারক চক্রটি এভাবে দেশের দুর্লভ, বিপন্ন ও বিরল প্রাণী চুরি করে দেশের বাইরে পাচার করে থাকে মর্মে প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।

বন্যপ্রাণী চুরি ও পাচার রোধে কাজ করা বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ৪৪টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত জানুয়ারিতে ৪৫৮টি, ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ৪৪, মার্চে ১২১, এপ্রিলে ১৪৩, মে মাসে ২৭৭, জুনে ১৬৭, জুলাইয়ে ৯৭৮, আগস্টে ৮৫৬ ও সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ১১১টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া প্রাণীগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ, গন্ধগোকুল, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, বানর, তক্ষক, লেমুর, হাতি, ভালুক, হনুমানসহ নানা ধরনের বন্যপ্রাণী। এসব বন্যপ্রাণীর দেশ থেকে চুরি হওয়ার পর সেটি প্রথম গন্তব্য হয় প্রতিবেশী কোনো দেশে। পরে সেখান থেকে চড়া দামে চীন, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ বেশকিছু দেশে পাচার করা হয়েছে। এ ছাড়া জীবিত প্রাণীর পাশাপাশি কচ্ছপের হাড়, হাঙরের চর্বি ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিদের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে থাকে।

বন্যপ্রাণী দমন ইউনিটের তথ্য বলছে, গত বছরের নভেম্বরেও ঠাকুরগাঁওয়ের কান্তিভিটা সীমান্ত থেকে উদ্ধার হয় একটি নীলগাই। গত কয়েক বছরে পঞ্চগড়, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁয় পাওয়া গেছে নীলগাই-বনরুইয়ের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। তবে এসব অঞ্চল থেকে নীলগাই বিলুপ্ত হয়েছে ১৯৪০ সালের পর পর। এ ছাড়া জলপাইগুড়ির গজলডোবায় ২০২২ সালে উদ্ধার হয়েছিল সাতটি ক্যাঙারু। সেগুলো অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশ হয়ে সেখানে গেছে বলে দাবি করেছিল ভারতের গণমাধ্যম। প্রাণী পাচারে ব্যবহার হচ্ছে বালিয়াডাঙ্গী, হিলি, শিবগঞ্জ, বুড়িমারী ও মেহেরপুর সীমান্ত। জলপাইগুড়ি লাগোয়া চিকেন নেক থেকে মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, চীন থাইল্যান্ডসহ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোয়ও যাচ্ছে এসব প্রাণী।

Share This Article

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়