আত্মসম্মান — অহংকার নয়, আত্মচেতনার নাম
শিরিন আকতার || বিএমএফ টেলিভিশন
আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে বিনয় আর ভদ্রতা শেখানো হয়, কিন্তু আত্মসম্মান শেখানো হয় না। ছোটবেলা থেকেই শিখি—“সবাইকে খুশি রাখতে হবে”, “রাগ দেখাবে না”, “সব কিছু মেনে নাও”—কিন্তু খুব কম মানুষ শেখায়, “নিজের মর্যাদার জায়গাটা কখনও ছাড়বে না।”
আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে বিনয় আর ভদ্রতা শেখানো হয়, কিন্তু আত্মসম্মান শেখানো হয় না। ছোটবেলা থেকেই শিখি—“সবাইকে খুশি রাখতে হবে”, “রাগ দেখাবে না”, “সব কিছু মেনে নাও”—কিন্তু খুব কম মানুষ শেখায়, “নিজের মর্যাদার জায়গাটা কখনও ছাড়বে না।”
ফলাফল? আমরা এমন প্রজন্মে পরিণত হয়েছি, যারা সব বোঝে, কিন্তু নিজের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভয় পায়—ভয় পায় ‘অহংকারী’ বা ‘অসহযোগী’ বলে আখ্যা পেতে।
আত্মসম্মান মানে কারও উপর আধিপত্য নয়, বরং নিজের অস্তিত্বকে সম্মান করা। এটা এক ধরনের অন্তর্গত সচেতনতা, যা বলে—“আমি অন্যের মতোই মূল্যবান।”
কেউ যখন নিজের অনুভূতির প্রতি সৎ থাকে, অন্যায় মেনে নেয় না, অপমানের বিনিময়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে না—তখনই সে প্রকৃত অর্থে আত্মসম্মান ধরে রাখে।
আজকের বাস্তবতায় আত্মসম্মান হারানো এক অদ্ভুত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অনেকেই ভাবেন, চুপ থাকা মানে বুদ্ধিমত্তা, সহ্য করা মানে পরিপক্বতা।
কিন্তু না—সব কিছু সহ্য করা পরিপক্বতা নয়, অনেক সময় তা নিজের প্রতি অবিচার।
একজন মানুষ যখন বারবার নিজের সম্মান বিসর্জন দেয়, তখন সে ধীরে ধীরে নিজের ভেতরকার আলো নিভিয়ে ফেলে।
আর একবার যদি নিজের সম্মান হারানোর অভ্যাস তৈরি হয়, তখন আর কোনো সম্পর্কই নিরাপদ থাকে না—না বন্ধুত্ব, না ভালোবাসা, না সমাজ।
আত্মসম্মান রক্ষা করা মানে অহংকারী হওয়া নয়। অহংকার মানুষকে একা করে দেয়, আত্মসম্মান মানুষকে স্থির করে।
অহংকারী মানুষ ভাবে—“আমি সবার চেয়ে বড়”,
কিন্তু আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ ভাবে—“আমি কারও চেয়ে ছোট নই।”
এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য সূক্ষ্ম, কিন্তু গভীর।
আজকের সময়ে সামাজিক সম্পর্কগুলো এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে, আত্মসম্মান রক্ষা করাই যেন একধরনের ‘বিপজ্জনক’ কাজ।
কেউ যদি নিজের সীমা টেনে দেয়, বলে “না”, তাহলে তাকে বলে অহংকারী।
কিন্তু একবার ভেবে দেখো, সীমা টেনে দেওয়া মানেই সম্পর্ক ভাঙা নয়—বরং তা সম্পর্ককে সম্মানজনক রাখার একমাত্র উপায়।
প্রতিদিন আমরা দেখি—মানুষ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে নিজের মর্যাদা বিসর্জন দিচ্ছে, ভালোবাসার নামে আত্মসম্মান হারাচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে স্বীকৃতির জন্য অন্যায় সহ্য করছে।
কিন্তু এর পরিণতি কী?
একসময় সেই মানুষটি নিজের ভেতরে ভেঙে পড়ে, নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।
যে সম্পর্ক নিজের সত্ত্বা কেড়ে নেয়, সেটি কখনো ভালোবাসা হতে পারে না; যে কাজ নিজের আত্মসম্মান কেড়ে নেয়, সেটি কখনো সফলতার নাম হতে পারে না।
আত্মসম্মানই মানুষকে শেখায় নিজের পাশে দাঁড়াতে। এটা শেখায় কাকে দূরে রাখতে হবে, কাকে কাছে টানতে হবে।
যে নিজের মূল্য জানে, সে অন্যেরও মূল্য দিতে জানে।
কারণ আত্মসম্মান মানুষকে বিনয়ী করে, অহংকার নয়।
অহংকার মানুষকে আড়ালে টেনে নেয়, আত্মসম্মান মানুষকে আলোয় রাখে।
জীবনে এমন অনেক সময় আসে, যখন মনে হয়—চুপ থাকলেই বোধহয় শান্তি আসবে।
কিন্তু সত্য হলো, নিজের প্রতি অন্যায় সহ্য করে কোনো শান্তি টেকে না।
কখনও কখনও নীরবতা নয়, একটি দৃঢ় “না”—সেটিই আত্মসম্মানের প্রকাশ।
তাই মনে রাখতে হবে, আত্মসম্মান মানে অন্যকে নিচু করা নয়, বরং নিজেকে নিচে নামতে না দেওয়া।
যে মানুষ নিজের সম্মান ধরে রাখতে পারে, সে কখনও অন্যের সম্মান নষ্ট করে না।
আর যে নিজেকে ভালোবাসে, সে পৃথিবীর প্রতিটি সম্পর্ককে সম্মান করতে শেখে।
আত্মসম্মানই মানুষের ভিতরে সত্যিকারের স্বাধীনতার জন্ম দেয়।
এটা শেখায় মাথা উঁচু করে বাঁচতে—কিন্তু কারও মাথা নিচু করিয়ে নয়।
এই পৃথিবীতে যে মানুষ নিজের সম্মানের জায়গাটা চিনে নিয়েছে, সে কখনো একা পড়ে না; কারণ তার পাশে থাকে নিজের মর্যাদা, নিজের বিশ্বাস, নিজের আলো।
তাই শেষে একটাই কথা—
অহংকার মানুষকে ফাঁপা করে, আত্মসম্মান মানুষকে পূর্ণ করে।
যে নিজেকে সম্মান করতে জানে, সে কখনও নিজের মতো মানুষ হতে ভয় পায় না।
লেখক : শিরিন আকতার
স্বত্তাধিকারী :উড়ান
সিইও :টেস্টি বেকার্স