পরকীয়া : সমাজে এক নিরব ঝড় , ভাংছে পরিবার ও মানষিক শান্তি

জহুরুল ইসলাম : || বিএমএফ টেলিভিশন

প্রকাশিতঃ রাত ০৯:৫৮, বৃহস্পতিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১০ আশ্বিন ১৪৩২
ছবি: বিএমএফ টেলিভিশন।

ছবি: বিএমএফ টেলিভিশন।

শব্দটা যতই ব্যক্তিগত ও গোপনীয় শোনাই মনে করুক, বর্তমান সমাজে এটি আর শুধুই দুই ব্যক্তির মধ্যে সীমিত কোনও ঘটনা নয়। শহর-গ্রাম, কুলা-অফিস—প্রায় প্রতিটি জীবনে কখনো না কখনো এই বিষয়টির ছায়া পড়ছে। বিশেষ করে বিবাহিত পুরুষ ও নারী—দু’পক্ষেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরকীয়ার সঙ্গে জড়ানোর প্রবণতা বেড়ে উঠছে, আর ডিভোর্সের পরও অনেকের মধ্যে আগের স্বামী/স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় থাকে। এই প্রেক্ষাপটেই আমি বিষয়টির সমাজতাত্ত্বিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলো বিশ্লেষণ করে অংশভিত্তিক একটি রিপোর্ট শুরু করছি।

পরকীয়া

শব্দটা যতই ব্যক্তিগত ও গোপনীয় শোনাই মনে করুক, বর্তমান সমাজে এটি আর শুধুই দুই ব্যক্তির মধ্যে সীমিত কোনও ঘটনা নয়। শহর-গ্রাম, কুলা-অফিস—প্রায় প্রতিটি জীবনে কখনো না কখনো এই বিষয়টির ছায়া পড়ছে। বিশেষ করে বিবাহিত পুরুষ ও নারী—দু’পক্ষেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরকীয়ার সঙ্গে জড়ানোর প্রবণতা বেড়ে উঠছে, আর ডিভোর্সের পরও অনেকের মধ্যে আগের স্বামী/স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় থাকে। এই প্রেক্ষাপটেই আমি বিষয়টির সমাজতাত্ত্বিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলো বিশ্লেষণ করে অংশভিত্তিক একটি রিপোর্ট শুরু করছি।

পরকীয়া কী? — ধারণা ও পরিভাষা

সাধারণভাবে পরকীয়া (অথবা ব্যভিচার/extramarital affair) বলতে বিবাহিত অবস্থায় অপরবর্তী কারও সঙ্গে আবেগিক বা শারীরিক সম্পর্ক বোঝায়। তবে বাস্তবে এর মানে অনেক ধরনের—কেবল মেসেজ-চ্যাট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতে পারে, আবার দীর্ঘমেয়াদি গোপন সম্পর্কও হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ প্রহেলিকা হল—আজকাল প্রযুক্তি ও যাচাইহীন সম্পর্কের স্বরূপটি কেবল শারীরিক নয়; আবেগগত নাও হতে পারে, তবু ঘর-সংসারে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

বর্তমান প্রবণতা —

বহু সামাজিক সমীক্ষা ও মিডিয়া রিপোর্ট থেকে মনে করা যায়—শহুরে এলাকার ব্যস্ত ও স্বাধীন জীবনযাত্রায় পরকীয়া তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যাচ্ছে। গ্রামের তুলনায় শহরে এবং শিক্ষিত ও স্ব-অর্থোপার্জিত মানুষের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট ধরণের ‘গোপন যোগাযোগ’ বেশি ঘটে। অন্যদিকে, প্রবাস ও ঘর-দূরত্বও এক বড় কারণ—একজন পতি বা পত্নীর অনুপস্থিতি সম্পর্ককে দুর্বল করে দিতে পারে, যা বাইরে থেকে ভরসা খোঁজার প্রবণতা উস্কে দেয়।

পরিসংখ্যান ও ধারণামূলক তথ্য:

সঠিক ও সমতুল্য জাতীয় জরিপের অভাবে পরকীয়ার প্রকৃত পরিসংখ্যান নির্ধারণ করা কঠিন, অনেকে বিষয়টি গোপন রাখেন, এবং সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে স্বীকার করে না। তবু শহুরে ছোট বড় অনলাইন ও একাডেমিক সমীক্ষা থেকে পাওয়া ধারণা বলছে—কিছু গবেষণায় বিবাহিতদের মধ্যে লক্ষ্যণীয় অংশ সফলভাবে বা সময়কালে পরকীয়ায় জড়িয়েছে।

কেন বাড়ছে—মূল সামাজিক কারণসমূহ:

নিচে প্রধান যে বিষয়গুলো বারবার দেখা যায়, সেগুলো সারগর্ভভাবে বর্ণনা করা হলো—

সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল কনট্যাক্ট: সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম, মেসেজিং অ্যাপ এবং অনলাইন ডাক-কথা গোপন আলাপকে সহজ করেছে। পুরনো বন্ধু বা প্রাক্তন সঙ্গীর সঙ্গে ‘এক ক্লিকে’ পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব—এটাই অনেক ক্ষেত্রে নতুন সম্পর্কের পথ প্রশস্ত করে।

শহুরে জীবনের একাকিত্ব ও একঘেয়েমি: কাজে ব্যস্ততা, দাম্পত্যে সময়ের অভাব, শিশুসন্তান ও দায়িত্ব—এসব কারণে আবেগঘাটতি তৈরি হলে বাইরের আলাপ বা সম্পর্ককে উৎসাহ পাওয়া যায়।

অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও সুযোগ-সুবিধা: প্রাপ্তি ও আর্থিকভাবে স্থিতিশীল হলে কেউ কেউ সম্পর্ক বজায় রাখার বা পুনরায় ঢোক দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়। কখনও কখনও আর্থিক সুবিধা অর্জন করতেই পুরনো সঙ্গীর কাছ থেকে সহায়তা নেওয়া হয়।

সামাজিক নৈতিকতার দ্বৈতমান: সমাজে পুরুষের জন্য উপেক্ষা ও নারীর জন্য কড়া দণ্ড—এ ধরনের দ্বৈততার কারণে পুরুষেরা তুলনামূলকভাবে বেশিক্ষণ ‘নিষ্পত্তি’ পায়, আর নারীরা দ্রুত সামাজিক কলঙ্কের সম্মুখীন হয়; ফলশ্রুতিতে সত্যতা লুকানো ও সম্পর্ক গোপন রাখা হয়।

বিবাহবিচ্ছেদ ও টান: ডিভোর্স বা বিচ্ছেদের পরও অনেকের আবেগগত টান অবশিষ্ট থাকে—এটাই প্রাক্তন সঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগ ধরে রাখার বড় কারণ। কেউ কেউ পারস্পরিক আর্থিক বা পারিবারিক অংশীদারিত্বের কারণে ধারাবাহিক যোগাযোগ রাখেন।

সামাজিক ও মানসিক প্রেক্ষাপটের সামান্য বিশ্লেষণ:

পরকীয়া কেবল ব্যক্তিগত সমস্যা নয়—এটি পরিবার ও সমাজকে প্রভাবিত করে। পরিবারের অভ্যন্তরে যখন আস্থা ক্ষয়ে যায়, তখন শিশুর অনুভবশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিদ্যালয়ে, সমাজে তাদের আচরণ ও আত্মমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উপরন্তু সামাজিক নেটওয়ার্কে বিচ্ছিন্নতা, কলঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে বিচ্ছেদের পর ব্যক্তি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়তে পারেন—বিশেষত নারীরা যাদের ক্ষেত্রে চাকরি-অর্থের বিকল্প সীমিত।

মানসিকভাবে, পরকীয়া যাকে করে—তাকে না-শুধু দোষারোপের সম্মুখীন হতে হয়, বরং অপর পক্ষে (যেটি ‘বাইরের সম্পর্ক’ বলে বোঝানো হয়) উপেক্ষিততা ও লুকানো দ্বন্দ্ব থেকে অতিরিক্ত মানসিক চাপের মুখে পড়ে। উভয় ক্ষেত্রেই পরিবার ভাঙার সম্ভাবনা বাড়ে

বাস্তব অভিজ্ঞতার গল্প:

১. করিম (বেসরকারি  কর্মকর্তা, নাম পরিবর্তিত)

“আমি এক ডিভোর্স নারীকে বিয়ে করেছিলাম। শুরুতে সব ঠিক থাকলেও কিছুদিন পর জানতে পারি, তার আগের স্বামীর সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। সে মেসেঞ্জার, কল—সবকিছুতে একগুঁয়ে। আমি বহুবার চেষ্টা করেছিলাম আস্থা স্থাপন করতে, কিন্তু সে ধ্বংসাত্মকভাবে আগের সম্পর্কের সাথে আবেগঘন যোগাযোগ রাখত।

চোখের সামনে আগের স্বামীর ম্যাসেজ ভেসে উঠত ।ধরা পড়ার পর বলত আর করব না । এভাবেই কেটে গেল দুইবছর । পরিবারের অন্যরা বলত সন্তান নিলে ঠিক হয়ে যাবে ।যথাযথভাবে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান এর জন্ম হলো কিন্তু সন্তান হওয়স্র হওয়ার পরও সে আগের স্বামীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখলো । করিম আরও বলেন সন্তানের মাথায় হাত দিয়ে কসম করার পরেও সে পরিবর্তন হয়নি। সোস্যাল মিডিয়ায় কেউ কাউকে আটকে রাখতে পারে না । আগের বিয়ে হয়েছিল সম্পর্ক করে তাই তাকে ভুলতে পারে নাই । শুধু কথা বলেই ক্ষ্রান্ত থাকেনা ।দেখা সাক্ষাৎ এমনকি প্রতি মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা তার কাছ থেকে নিতে থাকে । কোন নারী যখন কারর কাছ থেকে ঘরে বসে লক্ষ লক্ষ টাকা পাই তখন তার কি স্বামীর প্রতি কোন ভালোবাসা থাকে ?

তিনি বলেন তাকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করাই আমার কাল হয়েছে । মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে ছেড়ে যেতে পারিনা ।তিনি বলেন তার স্বামীর সাথে বহুবার কথা বলেও কোন লাভ হয়নি ।কারন উভয়েই গোপনে যোগাযোগ রাখতে চাই । এ নিয়ে মারামারি ঝগড়া ঝাটি লেগে থাকলেও কোন লাভ হয়নি । এখনও চলছে তাদের গোপন সম্পর্ক  । তিনি বলেন কথায় কথায় তার স্ত্রী বলেন তুই একটা অপদার্থ ।তুই আমার স্বামী হয়ে আমার জন্য কি করেছিস ? তোর মত অপদার্থ লোকের সাথে থাকি এটাই তোর সাত জননের কপাল । ও আমার স্বামী ছিল । এখনো আমাকে যে সহযোগিতা করে তাতে তোরে তো আমার দরকার নাই । আমার এই সংসার টিকে নেই । যে কোন মুহুর্তে ভেঙে যাবে 

২. তাসলিমা (গৃহবধূ, নাম পরিবর্তিত)

আমার স্বামী তার আগের বউয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্মসম্পর্ক রেখেছে । ফোনে যোগাযোগ রাখে। আমি আপত্তি জানিয়েও সে থামেনি। কখনও কখনও আমি নিজেই তার সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু অনুভব করি, আমার কথাগুলো কোনো প্রভাব ফেলে না। সন্দেহ, দ্বন্দ্ব আর অবিশ্বাস—সবই বাড়ছে। তাসলিমা বলেন বিয়ের আগে জানতাম না সে বিবাহিত ।বিয়ের কিছু দিন পর জানতে পারি সে বিবাহিত এবং তার সন্তান আছে  । সে তার আগের স্ত্রী কে ডিভোর্স দিয়েছে বলে জানান ।কিন্তু আমি অনেকবার দেখেছি এমনকি প্রমান পেয়েছি সে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখে ।শপিং করে দেয় । নিয়মিত খোজখবর রাখে । আমি কোনভাবেই সন্দেহ থেকে দুরে থাকতে পারিনা । মফস্বল শহরে থাকলেও নিয়মিত ঢাকায় আসে এবং এক সাথে ঘুরে বেড়ায় ।

এর মধ্যে আমিও একটা সংসার ছেড়ে এসেছি ।কিন্তু দুই নৌকায় থাকতে চাইনা তাই বাধ্য হয়ে আমার স্বামীকে নিয়ে গিয়ে দাড়িয়ে থেকে ডিভোর্স দেয়ার ব্যবস্থা করি ।কিন্তু ডিভোর্স এর পরেও তারা যোগাযোগ করে । নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে ।বাজার করে দিচ্ছে । ফ্ল্যাট ভাড়া করে আলিসান ভাবে রাখছে। এগুলো আমার  সহ্য হয়না । তার সাথে আমার এক বিন্দুও থাকতে ইচ্ছে করে না । যে কোন মুহুর্তে এই সংসার ভেঙে যাবে ।

৩. রাশেদ (ব্যবসায়ী)

আমার স্ত্রী ডিভোর্সের পর আগের স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। প্রথমে বিষয়টা হালকা মনে করেছিলাম। পরে দেখলাম তারা নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ করছে। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সংসার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সন্দেহ ও অবিশ্বাসের মধ্যে আর চলতে পারিনি।”

৪. লিজা (প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী)

“বিয়ে করার পর দেখলাম স্বামীর  সাথে  অফিসের সহকর্মীর ঘনিষ্ঠ  সম্পর্ক । দিনে রাতে তারা মেসেঞ্জারে যোগাযোগ রাখত। আমি প্রশ্ন করলে সে রেগে যেত। এমন অবস্থা চলতেই থাকলে আমি নিজেই বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে বাধ্য হই।”

৫. নাসরিন (প্রবাসীর স্ত্রী)

“স্বামী বিদেশে থাকায় আমি একাকিত্বে পড়ি। পাশের প্রতিবেশীর সঙ্গে আবেগঘন সম্পর্ক শুরু করি। পরে স্বামী জানতে পারলে হুমড়ি খেয়ে ঝগড়া হয়। সংসার ভাঙার মুখে এসে থামি। সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”

৬. আজিজা (নাম পরিবর্তিত, মধ্যবয়সী নারী)

“ডিভোর্সের পরও আমার স্বামী আগের বউয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। এটি মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছিল। আমি বুঝতে পারি, সম্পর্কের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা না থাকলে এসব বিষয় বাড়তে থাকে। আমি নিজেই সীমা নির্ধারণ করি, নইলে অবিশ্বাস আরও বাড়তো।”

৭. হোসেন (নাম পরিবর্তিত)

“দেশে থাকাকালীন স্ত্রী আমার আগের বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। প্রথমে এটি সামান্য মনে হলেও পরে বুঝলাম, এটি মানসিকভাবে আমাকে অস্থির করে। এটি পুরো সংসারে অনিশ্চয়তা ও দ্বন্দ্ব তৈরি করেছিল।”

৮. ফারজানা (নাম পরিবর্তিত, প্রাইভেট অফিসের কর্মী)

“আমার স্বামী প্রাক্তন সহকর্মীর সঙ্গে নিয়মিত কথা বলত। আমি বুঝতে পারিনি কখন সে আমার সঙ্গে কথা বলবে আর কখন প্রাক্তনকে সময় দেবে। এটি মানসিক অবসাদ সৃষ্টি করেছিল।”

৯. শহীদ (নাম পরিবর্তিত, সরকারি চাকরিজীবী)

“ডিভোর্সের পরও প্রাক্তন স্ত্রী নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। এটি আমাকে মানসিকভাবে দুর্বল করেছিল। সংসারে সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করলেও, সন্দেহ ও দ্বন্দ্বের কারণে কিছুই সহজ ছিল না।

১০. আশরাফ ( ছদ্মনাম )

আমার আগের স্ত্রীকে ডিভোর্স দেয়ার পরেও আমার স্ত্রীর মানষিক অত্যাচার দিনের পর দিন বেড়ে যায় । তোর সাথে তোর বউ এর এখনও সম্পর্ক আছে । কথায় কথায় এসব মানষিক অত্যাচারে সংসারে বিন্দুমাত্র সুখ নেই । সারাদিন ক্লান্ত শরীরে বাইরে থেকে এসে বউ এর মানষিক যন্ত্রণা আমাকে মানষিকভাবে অসুস্থ করে দেয় । এ থেকে বাচার জন্য কয়েকবার আত্নহত্যা করার চেষ্টা করতে চেয়েও করিনাই ।পরে ভেবেছি মরে গেলে এরা ভালো থাকবে ।

আমার স্ত্রী নিয়মিত আমাকে আমার মা তুলে গালিগালাজ এমনকি আমার লজ্জা থাকলে আমি আত্নহত্যা করতাম । তুই তো একটা বাটপার । তুই তো পুরুষ না ।তুই একটা মহিলা মানুষ । তুই একটা হিজলা ।এসব বলে মানষিকভাবে আমাকে অত্যাচার করে । ফলে সংসার ছাড়তে বাধ্য হয় আমি।

মূল বিষয়গুলো থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা-

১. বিশ্বাস ও আস্থা ভাঙার প্রভাব: প্রতিটি কেসেই দেখা যায়, খোলামেলা আলোচনা না থাকলে সন্দেহ ও দ্বন্দ্ব বাড়ে।

২. সন্তানের মানসিক ক্ষতি: বাবা-মায়ের দ্বন্দ্বে সন্তানের মানসিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৩. সামাজিক কলঙ্ক: ডিভোর্স বা পরকীয়া সম্পর্ক সামাজিকভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

৪. মেসেজ ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব: যোগাযোগের সহজলভ্যতা পরকীয়াকে উসকে দেয়।

গবেষণা ও পরিসংখ্যান-

বাংলাদেশে সমসাময়িক গবেষণা দেখাচ্ছে, বিবাহিত পুরুষ ও নারীর মধ্যে প্রায় ৩০–৩৫% কোনো না কোনো সময়ে পরকীয়ায় জড়িত ছিলেন বা আছেন। শহুরে অঞ্চলে সংখ্যাটি তুলনামূলকভাবে বেশি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জরিপ অনুযায়ী, ৪৫% বিবাহিত পুরুষ এবং ৩২% বিবাহিত নারী জীবনের কোনো এক সময়ে পরকীয়ায় জড়িয়েছেন।

বিশ্বব্যাপী, যৌথ পরিবারের ভাঙন, প্রবাস জীবনের দীর্ঘকালীন দূরত্ব এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরকীয়া শুধুমাত্র শারীরিক নয়, আবেগগত ও মানসিক সম্পর্কের মাধ্যমেও ঘটতে পারে।

গবেষণা দেখিয়েছে, ডিভোর্সের পরও প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা নতুন সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে। এটি বর্তমান সংসারে দ্বন্দ্ব ও সন্দেহ বাড়ায় এবং শিশুদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

আইনগত দিক-

বাংলাদেশে পরকীয়া সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ নয়। তবে এটি বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত। পারিবারিক আদালতে ডিভোর্স মামলা চালানোর সময়, আদালত প্রমাণের ভিত্তিতে পরকীয়া ও অবিশ্বাসের বিষয় বিবেচনা করে।

আইনজীবী সুমন রায়  বলেন-

যদি একজন পতি বা পত্নী প্রমাণ করতে পারেন যে, তার জীবনসঙ্গী পরকীয়ায় জড়িত এবং সংসারে আস্থা ক্ষয় করেছে, আদালত ডিভোর্সের পক্ষে রায় দিতে পারে। তবে প্রমাণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।

আইন অনুযায়ী, সন্তানদের অভিভাবকত্ব, আর্থিক দায়িত্ব এবং বিচ্ছেদের সময় বৈবাহিক সম্পত্তি ভাগ-বণ্টনও বিবেচনা করা হয়।

সামাজিক প্রভাব-

পরকীয়ার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় পরিবার এবং সন্তানের উপর। সন্তানরা বাবা-মায়ের দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ও বিচ্ছেদের প্রেক্ষাপটে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অধ্যাপক ড. মাহবুবা হক বলেন- পরকীয়া কেবল ব্যক্তিগত নয়,  এটি একটি সামাজিক সমস্যা। পরিবার ভাঙলে সমাজ দুর্বল হয়। সন্তানরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সমাজের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়।

বিশ্লেষকরা আরও উল্লেখ করেন, সামাজিক নৈতিকতার দ্বৈতমান—পুরুষের জন্য তুলনামূলকভাবে নরম আর নারীর জন্য কঠোর—পরকীয়াকে আরো জটিল করে।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ-

ইসলামে ব্যভিচার/পরকীয়া গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য। শাস্তি ও নৈতিকতার ব্যাখ্যা স্পষ্ট। খ্রিস্টান ও হিন্দুধর্মেও বিবাহিত অবস্থায় অন্য সম্পর্ককে গুরুতর অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়।

ধর্মীয় আলেম মুফতি হাসান বলেন- পরকীয়া নৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে অগ্রহণযোগ্য। এটি পরিবার ও সমাজে ভাঙন আনে। শিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বজায় রাখার মাধ্যমে আমরা এই প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারি।

সমাধান ও করণীয়-

১. খোলামেলা আলোচনা: দাম্পত্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও যোগাযোগ অপরিহার্য।

২. আস্থা ও শ্রদ্ধা বৃদ্ধি: পারস্পরিক আস্থা গড়ে তুলতে নিয়মিত সময় দেওয়া।

৩. সন্তানের নৈতিক শিক্ষা: ছোটবেলা থেকে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও পরিবারের মূল্যবোধ শেখানো।

৪. সোশ্যাল মিডিয়ার সচেতন ব্যবহার: গোপন যোগাযোগ বা সম্পর্ক রক্ষা না করা।

৫. কাউন্সেলিং ও পরামর্শ গ্রহণ: সংকট দেখা দিলে পেশাদার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা দাম্পত্য কাউন্সেলরের সহায়তা নেওয়া।

৬. সচেতন প্রচারণা: গণমাধ্যম ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে সচেতনতা মূলক প্রচারণা চালানো।

শেষ কথা -

পরকীয়া এখন সমাজে এক নীরব মহামারি। এটি শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং পরিবার ও সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আস্থা ও বোঝাপড়ার অভাব, সন্তানদের মানসিক ক্ষতি, সামাজিক কলঙ্ক—সব মিলিয়ে পরকীয়া এক গভীর সমস্যায় পরিণত হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক বন্ধনকে শক্তিশালী করা, নৈতিক শিক্ষা বৃদ্ধি, সোশ্যাল মিডিয়ার দায়িত্বশীল ব্যবহার, এবং সামাজিক সচেতনতা ছাড়া এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

লেখক ,
জহুরুল ইসলাম 
প্রধান সম্পাদক 
বিএমএফ টেলিভিশন

Share This Article

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়