বায়োমেডিকেলে ভর্তি হয়েই জানতে পারি বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ : স্কলারশিপপ্রাপ্ত ইবির মারুফ
মিনহাজুর রহমান মাহিম ইবি প্রতিনিধি || বিএমএফ টেলিভিশন
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ হিউস্টনে ফুল ফান্ডেড পিএইচ.ডির সুযোগপ্রাপ্ত মো. মারুফ হোসেন বলেছেন, “আমি যখন বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হই, সেদিনই জানতে পারি এই বিভাগের মাধ্যমে বিদেশে উচ্চশিক্ষার অনেক সুযোগ রয়েছে। আমাদের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মোঃ খাইরুল ইসলাম স্যার বিষয়টি আমাকে প্রথম দিনেই জানিয়ে দেন। স্যারের কথা ও অনুপ্রেরণায়, এবং নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা বিবেচনায় নিয়ে আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিই—আমি দেশের বাইরে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করবো।”
বৃহস্পতিবার (১২ জুন) বিএমএফ টেলিভিশনের সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ হিউস্টন-এ বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ‘ফল-২০২৫’ শিক্ষাবর্ষে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপে পিএইচ.ডি করার সুযোগ পেয়েছেন মো. মারুফ হোসেন। তিনি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেড ইনোভেটস ক্লাব জানান, “মারুফ হোসেনের এই কৃতিত্ব আমাদের জন্য গর্বের। তাঁর সাফল্য দেশের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের জন্যও এক বড় অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। আমরা তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি।”
স্কলারশিপপ্রাপ্ত মো. মারুফ হোসেন বলেন, "স্বাভাবিকভাবে আমরা অনেক সময় নিজেদের চিন্তাভাবনাকে নির্দিষ্ট কিছু গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখি। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের চিন্তাটা যেন স্বপ্নের মতোই মনে হয়। তবে এই গণ্ডির বাইরে ভাবতে পারলে—আর নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করতে পারলে—ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ কেবল কল্পনা নয়, বাস্তবতাও হয়ে উঠতে পারে।
মারুফ বলেন, “আমার গবেষণার যাত্রা শুরু হয় ২০২১ সালে। আমাদের বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোঃ শাহীন আলী ভাইয়ের মাধ্যমে আমি রিসার্চে আগ্রহী হই। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের University of Iowa-তে Biomedical Engineering বিভাগে পিএইচডি করছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার রিসার্চ গাইড হিসেবে ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও সুপারভাইজার ড. মোঃ খাইরুল ইসলাম স্যার। অনেক রাত জেগে তিনি আমাকে শিখিয়েছেন, সময় দিয়েছেন। Bio-Imaging Research Lab-এর সার্বিক সহযোগিতাও আমাকে এই পথে এগিয়ে যেতে অনেক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।”
তিনি বলেন, “স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি নিজেকে বুঝিয়েছিলাম, আজ নয়তো কাল, আমি স্কলারশিপ পাবোই—এই মনোভাবটাই আমাকে লেগে থাকতে শিখিয়েছে। কারণ, এ সেক্টরে কেউ কিছুদিন আগে পায়, কেউ কিছুদিন পরে; কিন্তু সৎ চেষ্টা করলে ব্যর্থতা নেই বললেই চলে। এই যাত্রায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল IELTS পরীক্ষায় অংশ না নিতে পারা। তবে আমি বিকল্প ভাষাগত দক্ষতার পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি।”
মারুফ জানান, “আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে থেকেই নিজের প্রোফাইল গুছিয়ে নিতে হয়েছে। একাডেমিক ফলাফল ভালো রাখা, স্কিল ডেভেলপমেন্ট, এক্সট্রা কারিকুলার একটিভিটিসে সক্রিয় থাকা—এই সবকিছুই ভূমিকা রেখেছে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে গবেষণায় আমার সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অভিজ্ঞতা। বর্তমানে আমার দশটি গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরেও বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট এখনো চলমান। এই গবেষণা অভিজ্ঞতাই আমাকে ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পাওয়ার পথে এগিয়ে দিয়েছে।
বিশেষ করে এবছর যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক হেলথ সেক্টরে অধিকাংশ ফান্ডিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় স্কলারশিপ পাওয়া কঠিন হয়ে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে আমার একাডেমিক রেজাল্ট, রিসার্চ ব্যাকগ্রাউন্ড এবং সামগ্রিক প্রোফাইলই আমাকে সফল করেছে। যদিও এই যাত্রা মোটেই সহজ ছিল না।”
“স্কলারশিপ পাওয়ার পর মনে হয়েছে, যেন প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি কিছু অর্জন করেছি। এই অর্জনের পেছনে আমার পরিবার, আমার শিক্ষকবৃন্দ, সুপারভাইজার, বন্ধু-বান্ধব, শুভানুধ্যায়ী এবং আমার বিভাগ—সকলেরই অবদান রয়েছে। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।
যারা বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হয়েছেন বা হতে যাচ্ছেন, বিশেষ করে যারা উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখছেন—তাদের উচিত হবে আগ্রহের বিষয়গুলোতে নিজেকে এক্সপ্লোর করা। আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে আমাদের বিভাগ তার প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যগুলো সফলভাবে বাস্তবায়ন করবে এবং গবেষণার ক্ষেত্রে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিভাগ হয়ে উঠবে।"— বলে মারুফ জানান।
বিভাগের শিক্ষার্থী আমিমুল এ হাসান রফিক বলেন, “আমাদের বিভাগের গর্ব, মারুফ ভাই যুক্তরাষ্ট্রে ফুল-ফান্ডেড স্কলারশিপে চান্স পেয়েছেন। এই খবরটা শুনে সত্যি আমি খুবই আনন্দিত এবং গর্বিত। একজন জুনিয়র হিসেবে আমি সবসময় মারুফ ভাইকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। উনার অধ্যবসায়, পরিশ্রম আর ইতিবাচক মানসিকতা আমাদের অনেক কিছু শেখায়। ভাইয়ার এই অর্জন শুধু উনার একার নয়, বরং আমাদের পুরো বিভাগের জন্যই একটা বিশাল অনুপ্রেরণা। এটা প্রমাণ করে—যদি লক্ষ্য ঠিক থাকে, পরিশ্রম করলে যেকোনো স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব।”
বিভাগের সভাপতি সহকারী অধ্যাপক ড. মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন মেধাবী ও পরিশ্রমী শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপসহ চান্স পেয়েছে—এটি আমাদের বিভাগের জন্য গর্বের ও আনন্দের একটি বিষয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচ.ডি করার সুযোগ পাওয়া অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই বছর আমাদের বিভাগ থেকে একজন শিক্ষার্থী এই সম্মানজনক সুযোগ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, এবং গত বছর তিনজন শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচ.ডি প্রোগ্রামে চান্স পেয়েছিল। এটি প্রমাণ করে যে, আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীরা গবেষণা, একাডেমিক উৎকর্ষতা এবং উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় মানদণ্ড পূরণে যথেষ্ট সক্ষমতা অর্জন করছে।”
তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে এই ধারাবাহিকতা আরও দৃঢ় হবে এবং উচ্চশিক্ষায় আমাদের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়বে। এ অর্জন আমাদের সকল শিক্ষক, গবেষণা সহযোগী এবং শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল।
আমি চান্সপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভকামনা জানাই এবং আশা করি, তার এই সাফল্য অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যেও উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বপন করবে। ভবিষ্যতেও আমাদের বিভাগ থেকে আরও বেশি শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ লাভ করবে—এই প্রত্যাশায় সকলের নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে আমি আশাবাদী।”