""নৈতিকতা কি এখন পুরোনো শব্দ''

শিরিন আকতার || বিএমএফ টেলিভিশন

প্রকাশিতঃ দুপুর ০১:৫৯, বুধবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৫, ২৩ আশ্বিন ১৪৩২
ছবি: বিএমএফ টেলিভিশন।

ছবি: বিএমএফ টেলিভিশন।

সময় বদলাচ্ছে দ্রুত, পৃথিবী ছুটছে অবিরাম গতিতে। প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, কিন্তু একই সঙ্গে যেন কিছু মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে। একসময় “নৈতিকতা” ছিল মানুষকে মানুষ বানানোর মূল ভিত্তি। আজ শব্দটা শুনলে অনেকেই মুখে একরাশ তাচ্ছিল্য হাসি ফোটায়—যেন নৈতিকতা এখন একেবারে পুরোনো কোনো শব্দ, অতীতের কোনো পাঠ্যপুস্তকে বন্দি ধারণা।

সময় বদলাচ্ছে দ্রুত, পৃথিবী ছুটছে অবিরাম গতিতে। প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, কিন্তু একই সঙ্গে যেন কিছু মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে। একসময় “নৈতিকতা” ছিল মানুষকে মানুষ বানানোর মূল ভিত্তি। আজ শব্দটা শুনলে অনেকেই মুখে একরাশ তাচ্ছিল্য হাসি ফোটায়—যেন নৈতিকতা এখন একেবারে পুরোনো কোনো শব্দ, অতীতের কোনো পাঠ্যপুস্তকে বন্দি ধারণা।

আমাদের সমাজে এখন বুদ্ধিমান বলা হয় সেই মানুষকে, যে সুযোগ বুঝে নিজের লাভ আদায় করে নিতে জানে। সৎ থাকা মানে যেন বোকামি, আর সরল হওয়া মানেই পিছিয়ে পড়া। মানুষ এখন প্রতিযোগিতার দৌড়ে এতটাই ব্যস্ত যে, কোথাও যেন “সঠিক আর ভুল”-এর রেখাগুলো মুছে যাচ্ছে। সত্য আর মিথ্যার ব্যবধান এখন কাগজের পাতায় সীমাবদ্ধ। বাস্তবে যেটা লাভজনক, সেটাই হয়ে উঠছে “সত্য”।

একসময় পরিবারে, স্কুলে, সমাজে শিশুদের শেখানো হতো—ভালো হও, অন্যের উপকার করো, মিথ্যা বলো না। এখন শিশুরা শেখে—ভালো না  হলে টিকে থাকা কঠিন, মিথ্যা না বললে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। নৈতিকতার শিক্ষা এখন বইয়ে আছে, কিন্তু জীবনে নেই।

তবুও আমরা কি সত্যিই বলতে পারি, নৈতিকতার দরকার শেষ?
না, কখনোই নয়। নৈতিকতা কখনো পুরোনো হয় না; এটি মানুষের আত্মার সঙ্গে জড়ানো এক চিরন্তন মূল্যবোধ। সমাজে যতই অগ্রগতি হোক, প্রযুক্তি যতই আধুনিক হোক—মানবিকতা ও নৈতিকতার বিকল্প আজও কেউ খুঁজে পায়নি।

আজ আমরা দেখি—সোশ্যাল মিডিয়ায় ভালো কাজের প্রচার যত বেশি, বাস্তব জীবনে সেসব তত কম। মানুষ এখন ভালো কাজও করে ছবি তোলার জন্য, স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য। অথচ সত্যিকারের নৈতিকতা নিরব, অদৃশ্য—যা বাহিরে দেখা যায় না, কিন্তু ভেতর থেকে সমাজকে আলোকিত করে।

নৈতিকতার অভাব কেবল ব্যক্তিকে নয়, পুরো সমাজকে দুর্বল করে দেয়। দুর্নীতি, ভণ্ডামি, মিথ্যাচার—এসব কেবল আইনি সমস্যা নয়, নৈতিক সমস্যা। আমরা যদি নৈতিকতা হারাই, তাহলে শিক্ষিত হলেও আমরা জ্ঞানী হতে পারি না, ধনী হলেও মানবিক হতে পারি না।

একজন মানুষ যখন নিজের বিবেকের সঙ্গে আপস করে, তখনই সমাজের পতন শুরু হয়।
আজ আমরা দেখি, মানুষ নিজের সাফল্যের জন্য অন্যের ক্ষতি করতে দ্বিধা করছে না; সত্যের পাশে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছে, কারণ তাতে “ক্ষতি হতে পারে”। অথচ ইতিহাস সাক্ষী—যে সমাজ সত্য ও নৈতিকতার ওপর দাঁড়িয়েছিল, সেই সমাজই টিকে গেছে যুগের পর যুগ।

নৈতিকতা মানে শুধু ভালো কাজ করা নয়, বরং নিজের ভুল স্বীকারের সাহস রাখা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার শক্তি থাকা। নৈতিকতা মানে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা, যেখানে কেউ দেখছে না—সেখানেও সঠিক পথে থাকা।

আমরা যদি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুন্দর পৃথিবী দিতে চাই, তবে প্রথমেই দরকার এই “পুরোনো শব্দ”টিকে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলা। পরিবারে, শিক্ষায়, কর্মক্ষেত্রে—প্রত্যেক জায়গায় নৈতিকতার পাঠ ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ প্রযুক্তি শেখায় “কীভাবে বাঁচতে হয়”, কিন্তু নৈতিকতা শেখায় “কেন বাঁচতে হয়”।

শেষ কথা, নৈতিকতা কোনো পুরোনো শব্দ নয়, বরং মানুষের অস্তিত্বের চিরন্তন সংজ্ঞা। নৈতিকতা হারালে আমরা শুধু সভ্যতা হারাই না, হারাই মানবতা, হারাই নিজের প্রতিচ্ছবি।
তাই আজ প্রশ্ন নয়—নৈতিকতা পুরোনো কি না, বরং প্রশ্ন হওয়া উচিত—
আমরা কি এখনো মানুষ থাকতে চাই?

শিরিন আকতার 
স্বত্তাধিকারী :উড়ান 
সিইও :টেস্টি বেকার্স

Share This Article

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়