একসঙ্গে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের প্রস্তুতি চলছে
ডেস্ক রিপোর্ট। || বিএমএফ টেলিভিশন
রাষ্ট্র সংস্কারে প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাস্তবায়নে গণভোট নিয়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। কোনো কারণে গণভোটে ‘না’ পাস করলে ভেস্তে যেতে পারে পুরো সংস্কার কার্যক্রম। তাই ‘হ্যাঁ’ পাস করাতে সরকার, নির্বাচন কমিশন (ইসি), রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কিন্তু ‘হ্যাঁ’র পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালানোর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো দ্বিধাবিভক্ত।
রাষ্ট্র সংস্কারে প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাস্তবায়নে গণভোট নিয়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। কোনো কারণে গণভোটে ‘না’ পাস করলে ভেস্তে যেতে পারে পুরো সংস্কার কার্যক্রম। তাই ‘হ্যাঁ’ পাস করাতে সরকার, নির্বাচন কমিশন (ইসি), রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কিন্তু ‘হ্যাঁ’র পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালানোর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো দ্বিধাবিভক্ত।
অবশ্য বিষয়টি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জাতীয় নির্বাচনের দিন পৃথক ব্যালটে একটি প্রশ্নেই ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ উত্তরে গণভোট নেওয়া হবে। প্রশ্নটির চারটি ভাগ থাকবে।
সংবিধানে গণভোটের বিধান না থাকায় এরই মধ্যে এসংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। অধ্যাদেশের আলোকে বিধিমালা প্রণয়নের কাজও শুরু হয়েছে। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) প্রয়োজনীয় সংশোধনীর অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। একই সঙ্গে গণভোটের অন্যান্য প্রস্তুতিও শুরু করেছে ইসি।
সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে একই দিনে গণভোট হবে। আগামীকাল রবিবার ইসির বৈঠকে এসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে। আগামী ১১ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার কথা রয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, গণভোটের আলোচিত চারটি প্রশ্ন নিয়ে। চার প্রশ্নের এক উত্তর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নিয়ে চলছে বিতর্ক।
সাধারণ মানুষের জন্য এ ধরনের প্রশ্ন কঠিন বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন।
গত ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত মক ভোটিংয়ে এর সত্যতা মিলেছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে শেরেবাংলানগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মক ভোট চলাকালে দেখা গেছে, গণভোটের বিষয়ে অধিকাংশ ভোটারের ধারণা নেই এবং তাঁদের অধিকাংশ প্রশ্ন না পড়েই ভোট দিয়েছেন। এ অবস্থায় গণভোটের চার প্রশ্ন নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তাঁদের মতে, সংসদ নির্বাচনে প্রতীক নিয়ে প্রার্থীদের ব্যাপক প্রচারণা থাকবে। ফলে গণভোট নিয়ে গ্রামগঞ্জে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। একই দিন সংসদ নির্বাচন ও গণভোট ব্যবস্থাপনার যেমন বিষয় রয়েছে, তেমনি গণনার ক্ষেত্রেও কোনটি আগে, কিভাবে করা হবে তা নির্ধারণের বিষয় রয়েছে। গণভোটের ফলাফল গণনায় সময় লাগবে বেশি, এটা বিবেচনায় রাখতে হবে। এসব কারণে গণভোট ঘিরে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, গণভোটে ‘হ্যাঁ’কে জয়ী করতে হবে। যদি ‘না’ জয়লাভ করে, তাহলে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি সংস্কার ও গণ-অভ্যুত্থান প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাই সরকার, ইসি, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজকে সমন্বিতভাবে গণভোটের প্রচার চালাতে হবে। এ বিষয়ে দ্রুত সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে।
গণভোট ফলপ্রসূ করতে দ্রুত প্রচার-প্রচারণা শুরুর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘গণভোটের প্রশ্ন বেশ জটিল। একটার মধ্যে চারটা প্রশ্ন, আবার চারটি প্রশ্নের মধ্যেও সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত অনেক বিষয় আছে। জনগণের বোঝার জন্য এটি নিয়ে যদি ব্যাপক প্রচারণা চালানো না হয়, তাহলে আমার আশঙ্কা, ভোটের দিন সবাই হয়তো সংসদ নির্বাচনের ব্যালটে ভোট দেবেন, আর গণভোটের ব্যালটটা হয়তো খালি থেকে যাবে।’
অবশ্য ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গণভোটের সার্বিক প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে গণভোট আয়োজনের প্রস্তুতিও হয়ে যাচ্ছে। একই দিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হওয়ায় বাড়তি কিছু প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। ভোটকক্ষ বা বুথের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। ভোটকক্ষ বাড়ানোর কারণে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার সংখ্যাও বাড়াতে হবে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, “জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে। আগামী ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে একসঙ্গে ভোটের বিষয়ে ‘মক ভোটিং’ করা হয়েছে। যেহেতু একই ভোটারকে দুটি ব্যালটে ভোট দিতে হবে, তাই সময় কিছুটা বেশি লাগবে। এ কারণে ভোটের সময় বাড়ানো ও বুথের সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়টি কমিশন সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে। ইসির আগামী সভায় এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।”
তিনি বলেন, ‘একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হলে ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে আসবেন। ফলে নির্বাচন উৎসবমুখর হবে। জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের প্রচার-প্রচারণা তথ্য মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় দ্রুত শুরু করবে।’
সূত্র জানায়, এরই মধ্যে অনলাইনে ‘হ্যাঁ’র পক্ষে প্রচারণা শুরু করেছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এই প্রচারণার কাজে যুক্ত হচ্ছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। পরে আরো কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। সরাসরি জনসম্পৃক্ততা রয়েছে এমন মন্ত্রণালয়গুলোকে প্রাথমিকভাবে গণভোট নিয়ে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে কাজে লাগানো হবে। ধর্ম মন্ত্রণালয়কে এ ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। কমিশনের পক্ষ থেকেও গণভোট নিয়ে আলাদা উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
সূত্র মতে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরই গণভোটের সচেতনতা নিয়ে মাঠে নামবে মন্ত্রণালয়গুলো। গণভোট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে প্রচারণায় ব্যবহার করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ভিডিও তথ্যচিত্র, পোস্টার বানানোসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টেলিভিশন, পত্রিকা, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ছাড়াও দেয়ালে টানানো হবে। এ ছাড়া রিল বা পোস্ট বানিয়ে তা ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ও টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় ছড়িয়ে দেওয়া হবে। ‘হ্যাঁ’ ভোট দিলে কী হতে পারে, ‘না’ ভোট দিলে কী হতে পারে—এসব বিষয়েও ছোট ছোট বার্তা জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।
এর জন্য মসজিদের ইমামদেরও কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। জুমার নামাজের খুতবায় তাঁরা যেন গণভোটের বিষয়ে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করেন সেই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য ইমামদের এক বা দুই দিনের একটি ওরিয়েন্টেশন করানো হতে পারে। ইমাম ও মসজিদ কমিটির মাধ্যমে গণভোট নিয়ে লিফলেট সারা দেশে পৌঁছে দেওয়া হবে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ওয়াজ মাহফিলে অনেক মানুষ উপস্থিত থাকে। সেখানেও বক্তাদের মাধ্যমে গণভোট নিয়ে প্রচার চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের তিনটি এজেন্ডার মধ্যে ‘সংস্কার’ অন্যতম। আর সংস্কারের মূল অংশ হচ্ছে গণভোট। তাই সরকার গণভোটের বিষয়ে সরাসরি কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসংক্রান্ত প্রচার-প্রচারণা ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রাথমিকভাবে চারটি মন্ত্রণালয়কে কাজে লাগানো হবে। পরে আরো কয়েকটি মন্ত্রণালকে যুক্ত করা হবে। কারণ, গণভোট নিয়ে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং কাজ।’
তিনি বলেন, “গণভোটের জন্য যে প্রশ্নগুলো রয়েছে, সেসব বিষয়ে ভোটারদের বোঝানো হবে। ওই সব প্রশ্নে কী ধরনের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, সেসব জনসাধারণকে জানানো হবে। এর বাইরে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিলে কী হতে পারে এবং ‘না’ ভোট দিলে কী হতে পারে, সেসব বিষয়েও সচেতন করা হবে।”
তবে গণভোটের বিষয়ে এখনো দ্বিধাবিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলো। কারণ চারটি প্রশ্নের একটি উত্তর নিয়ে আপত্তি রয়েছে বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের। তাদের প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন এবং ঘরে ঘরে গিয়ে লিফলেট ও পোস্টার বিলি করছেন। কিন্তু সেখানে গণভোট নিয়ে কোনো কথা নেই। কোনো প্রার্থী তাঁর লিফলেটে গণভোটের বিষয়টি উল্লেখ করেননি। এমনকি সমাজমাধ্যমে প্রচারের বিষয়ে দলগুলোর পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আর জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলো ‘হ্যাঁ’ ভোটের পক্ষে অবস্থা নিলেও আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করেনি। তবে নির্বাচনী সভা-সমাবেশে ‘হ্যাঁ’ ভোটের পক্ষে কথা বলছেন। এ ছাড়া বাম গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত দলগুলো গণভোট অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করছেন।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, “গণভোটে চারটি বিষয়ের ওপর একটাই উত্তর চাওয়া হয়েছে, এটা বিভ্রান্তিকর। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে গণভোটের যে উদ্দেশ্য, তা একটি ‘হ্যাঁ’ ভোটে বাস্তবায়ন করা যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আর গণভোটে ‘না’ জয়লাভ করলে তা সবার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই আমরা দলীয়ভাবে নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে ‘হ্যাঁ’ ভোটের বিষয়ে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করব। তবে এ বিষয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। এসংক্রান্ত মক ভোটিং সফল হয়নি। তাই কী কী বিষয়ের ওপর গণভোট এবং কিভাবে ভোটটা দেবে, তা নিয়ে জনগণকে সচেতন করা জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে বলে আশা করছি।”