৪৫ বাংলাদেশি গ্রেফতার, উত্তপ্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি
আন্তর্জাতিক ডেক্স। || বিএমএফ টেলিভিশন
বাংলাদেশে ফেরার চেষ্টা করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় ধরা পড়লেন অন্তত ৪৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক। তাদের মধ্যে ছিলেন ১৫ জন মহিলা ও ১১ জন শিশু।
বাংলাদেশে ফেরার চেষ্টা করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় ধরা পড়লেন অন্তত ৪৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক। তাদের মধ্যে ছিলেন ১৫ জন মহিলা ও ১১ জন শিশু।
বৈধ নথিপত্র ছাড়াই সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা চালানোর সময় হাকিমপুর এলাকায় বিএসএফ জওয়ানরা তাদের আটক করেন। পরে তাদের বসিরহাট থানার হাতে তুলে দেওয়া হয় বলে জানান বসিরহাটের পুলিশ সুপার হোসেন মেহেদি রহমান।
সীমান্তে এই গ্রেফতার ঘিরে নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতি। ঠিক এই সময়েই চলছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ভোটার তালিকা সংশোধন অভিযান — বিশেষ ইনটেনসিভ রিভিশন বা SIR। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভোটার তালিকা পুনর্নবীকরণ হচ্ছে, কিন্তু সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে গভীর আতঙ্ক।
ভোটার কার্ড থাকা সত্ত্বেও নাম কেটে যাওয়ার ভয়ে অনেকেই উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন। স্থানীয়দের দাবি, বিএলও-রা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, পুরোনো কাগজপত্র খুঁজে দেখতে বলছেন, অথচ ২০০২ সালের আগের কাগজপত্র অনেকেরই নেই।
বিশরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মহম্মদ আলম বলেন, “আমার ভোটার কার্ডে নাম আছে, ভোট দিয়েছি, বউয়েরও নাম আছে, কিন্তু ২০০২ সালের আগের কোন নথি আমাদের নেই, এখন যদি নাম কেটে দেয়, কোথায় যাব?”
আরেক নারী সাবিনা বিবি বলেন, “আমি এখানেই জন্মেছি, কিন্তু মা-বাবার কোন কাগজ নেই, যদি তাদের দেশ ছাড়তে হয় আমি একা থাকব কীভাবে? সবাই ভীষণ আতঙ্কে আছি।”
স্বরূপনগরের ধৃতদের ঘটনা যেন এই ভয়কেই আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এই ঘটনাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বলেছেন, “বাংলাদেশি মুসলমান তাড়াতাড়ি বাংলা ছাড়, পালাও, ডিটেক্ট, ডিলিট, ডিপোর্ট।”
তার আরও দাবি, “নিউ মার্কেট এক সময় ফাঁকা করে দিয়েছিলাম, আবার করব, আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে ফাঁকা হয়ে যান।”
অপরদিকে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, “বাংলাদেশি ঢুকল কী করে? সীমান্ত তো বিএসএফের আন্ডারে। আগে ঢুকেছে, এখন বের হচ্ছে, আর কেন্দ্রীয় সরকার বলছে সীমান্ত খুলে দেবে — এ কেমন দ্বিচারিতা?”
রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মাঝখানে সাধারণ মানুষ যেন আরও বিভ্রান্ত ও আতঙ্কিত। প্রশাসনের একাংশ বলছে, ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে এখন বহু মানুষ নিজের পরিচয় নিয়ে সন্দেহে পড়েছেন। যাদের পিতা-মাতা বা দাদা-দাদি দীর্ঘদিন আগে এসেছেন, তারা এখন নাগরিকত্বের প্রমাণ নিয়ে দুশ্চিন্তায়।
স্থানীয় সমাজকর্মীরা বলছেন, “যারা সীমান্তের আশপাশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাস করছে, তারা এখন হঠাৎ করেই ‘অবৈধ’ ট্যাগ পাচ্ছে, এটা অমানবিক।”
সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে এখন ভয় ও গুজবের পরিবেশ। অনেকেই বলছেন, বিএসএফ রাতের দিকে টহল বাড়িয়েছে, এবং প্রতিটি অচেনা চলাচলকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে খবর, SIR প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই বিশরপাড়া, বাগদা, গাইঘাটা, হাকিমপুর, হেমতাবাদ সহ একাধিক এলাকায় বহু পরিবার আত্মগোপনে চলে গেছে।
প্রশাসন বলছে, এই আতঙ্ক অযৌক্তিক, কিন্তু মাটির মানুষের কথা বলছে অন্য কিছু। এক শিক্ষক জানান, “গ্রামে এখন লোক কমে গেছে, যারা পারছে আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেছে, কাগজ-কলম নিয়ে দৌড় শুরু হয়েছে।”
রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি ক্রমেই বিস্ফোরক হয়ে উঠছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি এক সভায় বলেছেন, “দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় সবচেয়ে বড় বিপদ অনুপ্রবেশকারীরা, ভারতে থাকা সব অনুপ্রবেশকারীকে বের করেই ছাড়ব।”
এই মন্তব্যের পর থেকেই রাজ্যে বিজেপি নেতারা আরও আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছেন। অন্যদিকে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস বলছে, “অনুপ্রবেশের অভিযোগ পুরোটাই রাজনৈতিক চাল, ভোটের আগে আতঙ্ক ছড়ানোর জন্যই এই নাটক।”
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষই নিজেদের ভোটব্যাঙ্ককে সংহত করার চেষ্টা করছে। রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ভয় ছড়ালে তৃণমূলের সহানুভূতি বার্তা, আর অন্যদিকে কঠোর অবস্থান নিয়ে বিজেপির জাতীয়তাবাদী বার্তা — দুই দিকেই রাজনৈতিক লাভের হিসাব চলছে। কিন্তু বাস্তব চিত্রে সীমান্তবর্তী এলাকার সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি বিপাকে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, ৪৫ জন ধৃত সত্যিই কি অনুপ্রবেশকারী, নাকি তারা সেই আতঙ্কিত মানুষদের অংশ যারা নিজেদের নাগরিকত্ব নিয়ে বিভ্রান্ত?
বিএসএফ ও পুলিশ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি ধৃতদের পরিচয় যাচাইয়ের অগ্রগতি। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এই ধরনের ঘটনায় আইন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি মানবিকতা বজায় রাখা জরুরি।
একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন গত কয়েক বছরে সতর্ক করেছে, “অবৈধ অনুপ্রবেশের নামে বহু প্রকৃত নাগরিকও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।”
স্থানীয়দের অভিযোগ, সীমান্ত এলাকায় কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত দালাল চক্র এখন আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে লোক ঠকাচ্ছে। নাম বাদ পড়বে বা জেলে পাঠানো হবে বলে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা হচ্ছে। ফলে আতঙ্কের পাশাপাশি জন্ম নিয়েছে অসহায়ত্ব। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক বক্তব্য আরও উসকানি দিচ্ছে।
এক প্রবীণ সমাজকর্মীর ভাষায়, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দরকার প্রশাসনের আশ্বাস, কিন্তু সবাই কথা বলছে রাজনীতি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, SIR প্রক্রিয়া যদি স্বচ্ছ ও মানবিকভাবে সম্পন্ন না হয়, তবে তা এক নতুন সামাজিক বিভাজনের জন্ম দেবে। কারণ সীমান্তের দুই পাশে যে মানুষগুলো একই ভাষায় কথা বলে, একই সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে, তাদের ওপর এই ধরনের সন্দেহ আর বিভাজন ভবিষ্যতে বড় মানবিক সংকটে পরিণত হতে পারে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যতই থাকুক, মানবিক বিবেচনাই এখন সময়ের দাবি।